চট্টগ্রাম, , শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪

admin

ইতিহাসের সাক্ষী লোহাগাড়া

প্রকাশ: ২০১৭-০৯-০৪ ০৯:১২:৫৩ || আপডেট: ২০১৭-০৯-০৪ ০৯:১২:৫৩

 

মোহাম্মদ ইলিয়াছ : প্রাচীনকাল থেকে আরকানী শাসনের অধীনে ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চল। আরকানী চন্দ্র-সূর্য বংশ দীর্ঘকাল এ অঞ্চল রাজত্ব করে। তখন লোহাগাড়াসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলে হিন্দু- বৌদ্ধ অধিবাসীদের আগমন ঘটে। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে সুদুর আরব দেশ থেকে বণিকরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে আসেন। সে সময়ে আরাকানে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ (১৩৩৮-১৩৪৬ খ্রি.) চট্টগ্রাম জয় করে মুসলিম শাসন ব্যবস্থা চালু করেন। ঐ সময়ে হযরত বদর শাহ (রহ.)সহ ১২ জন আউলিয়া চট্টগ্রাম বিজয়ের অভিযানে ছিলেন। হযরত পীর বদর শাহ (রহ.)‘র চাটি বা চেরাগই চাটগাঁও বা চাটিগাঁও নামের মূল উৎস। পরবর্তীতে সবচেয়ে এ খ্যাত নাম চাটিগাঁও বিবর্তন হয়ে চাটিগ্রাম এবং অবশেষে চট্টগ্রাম।

 

জানা যায়,চট্টগ্রাম অঞ্চল আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.)‘র শাসনামলে চারটি ভাগে ভাগ ছিল। প্রত্যেক অঞ্চলে একেক জন শাসন কর্তা নিযুক্ত হতেন। প্রথম বিভাগ মীরসরাই থানা নিয়ে, দ্বিতীয় বিভাগ সীতাকুন্ড থানা নিয়ে, তৃতীয় বিভাগ কর্ণফুলী নদীর উত্তর দিকস্থ চট্টগ্রাম ও চতুর্থ বিভাগ কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ দিকস্থ চট্টগ্রাম নিয়ে গঠিত। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খান (১৬৬৬-১৬৭৮,১৬৮০-১৬৮৮খ্রি.)‘র পুত্র বুজুর্গ উমেদ খানের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম দখল ও আরকানী শাসনের অবসান হয়। তখন চট্টগ্রামের নামকরণ হয় ইসলামাবাদ।

এ সময়ে শঙ্খনদী পর্যন্ত মোঘলদের অধিকারে চলে আসে। কংলা প্রু দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা থাকাকালীন সময়ে আরকানীরা বঙ্গোপসাগরের উপকূলবাসীদেরকে প্রতিনিয়ত অত্যাচার করতো। তখন দোহাজারী দূর্গের সেনাপতি আধুখা‘র নেতৃত্বে মোঘল বাহিনী শঙ্খনদীর দক্ষিণ অংশে অভিযান শুরু করে। মোঘল বাহিনীর আক্রমনে আরাকানী বাহিনী পরাজিত হয়ে গভীর অরণ্যে পালিয়ে যায়। ধারণা করা হয়, সে সময়ে লোহাগাড়া অঞ্চলে উভয় পক্ষের বহু সৈন্য হতাহত হয়। আধু খা পাহাড়ি অঞ্চলে লোহার দন্ড গেঁড়ে বিজয় নিশান উত্তোলন করেন। বিজয় স্তম্ভের পাশে স্থাপন করেন সৈন্যদের গড় (দূর্গ)। লোহার দন্ড ও গড়কে কেন্দ্র করে এলাকাটির নামকরণ হয় লোহারগড়। পরবর্তীতে লোহারগড় পরিমার্জিত হয়ে লোহাগাড়া নামকরণ হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়,চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল টারসিয়ারী যুগের। এ যুগের শেষের দিকে সাতকানিয়ার (লোহাগাড়াসহ) পাহাড়ের উৎপত্তি হয়েছে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিমের মতে, বান্দরবানের বসবাসরত উপজাতিদের পূর্বপুরুষরা দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করত। উপজাতিরা সম্ভবত স¤্রাট অশোকের সময়ে পাহাড়ি অঞ্চলে এসেছেন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চল ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধাজনক স্থান হওয়ায় মধ্যযুগে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ব্যবসায়িরা সমুদ্র পথে এ অঞ্চলে আসতে থাকে। আরাকান রাজারা ১১৬৭ খ্রি. পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া অঞ্চল শাসন করেন। আর ১৭৬০ খ্রি. পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ চট্টগ্রাম অঞ্চল মোঘলদের শাসনে ছিল। ১৭৬০ খ্রি. নবাব মীর কাসিম আলী চট্টগ্রামের শাসনভার ইংরেজ কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়।

১৭৭২ খ্রি. কোম্পানি রাজস্ব সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামকে ৯টি চাকলায় ভাগ করে। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে পটিয়া, দোহাজারী, আনোয়ারা ও বাঁশখালীসহ ৪টি চাকলা হয়। সাতকানিয়াকে রাখা হয় দোহাজারী চাকলায়। উক্ত চাকলা ব্যবস্থায় সাতকানিয়া তথা লোহাগাড়ার সীমারেখা দেয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানের পুত্র বুজুর্গ উমেদ খান চট্টগ্রাম আঞ্চলকে ৭টি চাকলায় ভাগ করেন। ১৭৯৮ খ্রি. ফ্রান্সিস বুকানন নামক এক ইংরেজ কৃষি বিজ্ঞানী সাতকানিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ভ্রমন করে সাতকানিয়ার পাহাড়সমুহে পান, তামাক ও বিভিন্ন তরিতরকারির কথা, জীবজন্তুর কথা ও ধান চাষের কথা লেখেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সাতকানিয়াসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহুবার জরীপ কার্য চালায়। এ জরীপ রির্পোটে সাতকানিয়া (লোহাগাড়াসহ) অঞ্চলের তথ্য রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অপরদিকে ব্রিটিশরা এতদাঞ্চলের জমিদারী ও শাসনভার গ্রহণের পর অনেকবার জরীপ কার্য চালায়। সিজিএস এলেন নামক এক ইংরেজ ১৮৮৮-১৮৯৮ খ্রি. পর্যন্ত ক্যাডাষ্ট্রাল সার্ভের মাধ্যমে অবিশ্বাস্য ভূমি জরীপ ও ভূমি রেকর্ডের কাজ সমাধা করেন। এ জরীপ বিশ্লেষণ করলে লোহাগাড়া নামকরণের ইতিহাস উদ্ধার করা যাবে বলে সংশ্লিরা মনে করেন। এছাড়াও ১৯২১-১৯২৮ খ্রি. হয়েছে রিভিশনাল (আরএস) জরীপ। এ জরীপে সাতকানিয়া-লোহগাড়ার অনেক তথ্য খুঁজে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হয়।

প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)‘র আগমনের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসারে সুফী- দরবেশগণ চট্টগ্রাম- আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে কালক্রমে এতদাঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফলে লোহাগাড়ায় অনেক পীর-দরবেশ ও সুফী সাধকের আবাসস্থল গড়ে ওঠে। দীর্ঘদিন যাবৎ আরাকানীদের শাসনামলে এ অঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। কালক্রমে অঞ্চলটি মোঘল সা¤্রাজ্যের অধীনে চলে যাওয়ার সময় আরাকানীদের সাথে মোঘলদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ হত। আরাকান রাজার আক্রমনকে মোকাবেলা করতে মোঘল স¤্রাটরা দু‘জন অধিনায়ককে শঙ্খ নদীর উত্তর পাশে মোতায়েন রাখতেন। এরা হলেন খান পরিবারের বেগম করিমুন্নেছার পূর্ব পুরুষ ও হাজারী পরিবারের ভাগিরথ সিংহ হাজারীর পূর্ব পুরুষ। যুদ্ধে আরাকানী রাজা পরাজিত হয়ে নাফ নদীর দক্ষিণে গিয়ে তাদের রাজ্য সীমা সংকুচিত করে। মগরা এ অঞ্চল থেকে চলে যাওয়ার সময় অনেকেই লোহা জাতীয় ধন-সম্পদ মাটির নীচে গেঁড়ে (গর্ত করে) পালিয়ে যায়। লোহা জাতীয় ধন-সম্পদ মাটির নীচে গাঁড়া করে রাখার ফলে লোহাগাড়া নামকরণ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

তাজমহলের নির্মাতা স¤্রাট শাহজাহানের (১৬২৭-১৬৫৮খ্রি.) ১৬৫৬ খ্রি. বার্ধক্যজণিত অসুস্থতায় তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র দারাশিকো সিংহাসনের দাবিদার হন। কিন্তু তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে ভাই শাহ সুজাকে সিংহাসন দখলের জন্য প্ররোচিত করেন। এ অবস্থায় শাহ সুজা ১৬৬০ খ্রি. নিজেকে বাংলার সুলতান ঘোষণা দেন। সুজার এ ঘোষণা স¤্রাট শাহজাহান ও দারাশিকো বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যা দিয়ে রাজকীয় বাহিনী প্রেরণ করেন। যার ফলশ্রুতিতে সুজা বিশাল বাহিনী নিয়ে ইসলামাবাদ হয়ে আরাকানে পালিয়ে যায়। লোহাগাড়া নামকরণের প্রসিদ্ধ জনশ্রুতি হচ্ছে, শাহ সুজা লোহাগাড়া হয়ে আরাকানে পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পাহাড়বেষ্টিত চুনতির মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে সেখানে যাত্রা বিরতি করেন। চুনতি থেকে চলে যাওয়ার সময় তিনি সেখানে চিহ্নস্বরূপ একটি লোহার দন্ড গেঁড়ে দিয়ে যান। লোহার দন্ড গেঁড়ে রাখার ফলে লোহাগাড়া নামকরণ হয়েছে। তবে এ কথা অস¦ীকার করার উপায় নেই যে, লোহারদীঘি মনে করিয়ে দেয় লোহাগাড়া নামকরণের উৎপত্তি। ঐতিহাসিকবিদদের মতে, অবিভক্ত সাতকানিয়া অঞ্চলে সোনাকানিয়া, রুপকানিয়া, লোহাগড়া ও চুনতিসহ সাতটি খনি ছিল। লোহাগাড়ায় লোহার খনি ও চুনতিতে চুনাপাথরে খনি ছিল। লোহাগড়ার খনি থেকে লোহা উত্তোলন করার কারণে লোহাগাড়া নামকরণ হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তবে লোহাগাড়া নামকরণের ক্ষেত্রে লোহা-গেঁড়ে- গাঁড়া এ শব্দ তিনটির সম্পৃক্ততা আছে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

শাহ সুজার আমলে আরকান সড়ক (চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক) স্থাপিত হলে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার প্রশাসনিক কাঠামো গুরুত্ব পায়। ১৭৬৭ খ্রি. জেলা কেন্দ্রে কালেক্টরী পদ্ধতি চালু হলে এ অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সাতকানিয়ার দেওদিঘীতে সাতকানিয়া- লোহাগাড়ার কালেক্টরী অফিস স্থাপিত হয়। ১৮৯৭-৯৮ খ্রি. সাতকানিয়ার সমগ্র অঞ্চল নিয়ে পুরো প্রশাসনিক অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়। লোহাগাড়াকে সাতকানিয়াতে অর্ন্তভূক্ত করা হয়। ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় চুনতি পুলিশ ফাঁড়ি। ১৯১৭ সালে গঠিত হয় সাতকানিয়া থানা। ১৯৮১ সালের ২০ মে গঠিত হয় লোহাগাড়া থানা। ১৯৮৫ সালে লোহাগাড়া উপজেলায় উন্নীত হয়। এ উপজেলা চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত।

এটির উত্তরে সাতকানিয়া উপজেলা ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা, পূর্বে লামা উপজেলা, দক্ষিণে বান্দরবান পার্বত্য জেলা ও লামা-চকরিয়া উপজেলা এবং পশ্চিমে বাঁশখালী ও সাতকানিয়া উপজেলা। এ উপজেলার মোট আয়তন ২৫৮.৮৭ বর্গ কিলোমিটার। ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে উপজেলাটি গঠিত। ইউনিয়নগুলো হচ্ছে- ১নং বড়হাতিয়া, ২নং আমিরাবাদ,৩নং পদুয়া, ৪নং চরম্বা,৫নং কলাউজান, ৬নং লোহাগাড়া, ৭নং পুটিবিলা, ৮নং চুনতি ও ৯নং আধুনগর ইউনিয়ন। ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ূর অর্ন্তগত এ অঞ্চলটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ভৌগলিক কারণে এটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পাহাড়, অরণ্য,নদী, খাল, বিল,ঝিল রয়েছে অঞ্চলটিতে। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে দেশসহ সারাবিশ্বে অঞ্চলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *