চট্টগ্রাম, , বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

admin

১৯ নয় ১৮ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার দূতাবাস ঘেরাও করবে হেফাজত

প্রকাশ: ২০১৭-০৯-০৯ ১১:৪৭:৩১ || আপডেট: ২০১৭-০৯-০৯ ১১:৪৭:৩১

বীর কন্ঠ ডেস্ক: বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে মুসলমানদের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন ও অব্যাহত গণহত্যার  প্রতিবাদে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে হেফজাতে ইসলাম বাংলাদেশ। এছাড়াও আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর জুমাবার দেশব্যাপী হেফজাতে ইসলামের ডাকে বিক্ষোভ ও গণমিছিল, ২০ সেপ্টেম্বর বুধবার জাতিসংঘ ও ওআইসি মহাসচিব বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান, মসজিদ মাদরাসায় কুনুতে নাজেলার আমল জারি করার নির্দেশ ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় ত্রাণ সাহায্য পৌঁছানোর জন্য হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে ত্রাণ তহবিল গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

 

আজ শনিবার (০৯সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মলেনে এসব কর্মসুচী ষোষণা দেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী।

 

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বাবুনগরী বলেন, পৃথিবীর অন্য কোথাও নয়; আমাদেরই সীমান্তবর্তী, প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারের আরাকানে ঘটছে সাম্প্রতিককালের ভয়াবহ গণহত্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। আমরা অপরিসীম মর্মবেদনা ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রত্যক্ষ করছি, আমাদের ঘরের পাশে আরাকান রাজ্যের নিরীহ, নিরস্ত্র ও বেসামরিক মানুষকে প্রতিদিন পশুর মতো জবাই করে হত্যা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর মিয়ানমার সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সন্ত্রাসী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত ফ্যাসিবাদী জুলুম ও রাষ্ট্রীয় গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে। নিরীহ রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আরাকানের হিন্দুদের ওপরও সম্প্রতি হামলা হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের নৃশংসভাবে হত্যা করে শরীর টুকরো টুকরো করে নাফ নদীসহ খাল, বিল, জলাশয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য মুসলিম মা বোনেরা ধর্ষণ, গুম ও নির্মম হত্যার শিকার। নারী, শিশু ও বৃদ্ধরাও হত্যাকা- থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আক্ষরিকভাবেই সেখানে রক্তের নদী বইছে। রক্তাক্ত আরাকান, রক্তাক্ত মুসলমান কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের কর্তব্য পালন করছে না। চীন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী খুনি মিয়ানমার সরকারকে নির্লজ্জ সমর্থন দিয়েছে। ইহুদীবাদী ইসরাঈল অস্ত্র ও সমর প্রশিক্ষক সরবরাহ করছে। এ থেকেই বুঝা যায় এটা শুধু ভূরাজনৈতিক সমস্যা নয়, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। মুসলিম সভ্যতা ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বহুদেশীয় এই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সচিত্র প্রমাণ ও বাস্তবতা প্রতিদিন আমাদের সামনে আসছে।

 

আরাকান ভূখণ্ড থেকে মুসলিম জাতিসত্তাকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করে দেবার হীন উদ্দেশ্যে পূর্বঘোষিত ও পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হচ্ছে। দেশটির সামরিক বাহিনী বেসামরিক বৌদ্ধ জনগণকে অস্ত্রে সজ্জিত করে হত্যাকা-ে প্ররোচিত করছে। গ্রামের পর গ্রাম, পাড়া-মহল্লা ও বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আরাকানে এই গণহত্যার সংবাদ বিশ্বমিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। দু’চারটি সচিত্র সংবাদ দেখলেই কোনও বিবেকবান মানুষ স্থির থাকতে পারেন না। অথচ মুসলিমদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ সরকারপ্রধান ক্ষমতার মোহ ও রাজনৈতিক স্বার্থে মায়ানমার সরকারের একতরফা হত্যাকা- ও বর্বরোচিত অত্যাচারের ব্যাপারে বরাবরই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।

 

হেফাজত মহাসচিব বলেন, ঐতিহাসিকভাবে আরাকান মিয়ানমারের অংশ ছিলো না। আরাকান একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ছিল। ১৪৩০ সাল থেকে ১৭৮৪ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৫৪ বছর স্বাধীনভাবে মুসলমানরা এ ভূখ- শাসন করেছে। ১৭৮৪ সালে বর্মিজ রাজা বর্মণ আরাকান দখল করে নেয়। ব্রিটিশরা ১৯৪৮ সালে মিয়ানমারকে স্বাধীনতা দেওয়ার সময় স্বায়ত্বশাসিত আরাকানকে মিয়ানমারের সাথে জুড়ে দেয়, যা ছিল মূলত ষড়যন্ত্র। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমারের সামরিক শাসক জেনারেল নে উইন এসে আরাকানের স্বায়ত্বশাসন রহিত করে। ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাতিল করে। নাগরিকত্ব বাতিল করে তারা ধারাবাহিকভাবে এই মর্মে মিথ্যাচার করতে থাকে যে, রোহিঙ্গারা বর্মী নয়, তাদের আদি ও উৎপত্তি হলো বাংলাদেশে। আরাকানে তারা বাংলাদেশী অনুপেবেশকারী। এই জঘন্য মিথ্যাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য তাদের ভাষায় এসব অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদেরকে তারা হটিয়ে দিচ্ছে। তাদের কোন স্বাধীনতা নেই, দেয়া হয় নি কোন মানবিক অধিকার।

এই দাবি যে কত স্ববিরোধী তার স্বপক্ষে বহু তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। এখানে উল্লেখ করতে চাই, ১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সুলতান মাহমুদ, আবুল বাশার, আব্দুল গাফ্ফার, জোহরা বেগম প্রমুখসহ উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক ব্যক্তি আরাকানের মুসলিম প্রধান এলাকাগুলো থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে দেশটির পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

 

এর পর ১৯৯০ সালে যখন সামরিক বাহিনীর অধীনেই প্রথমবারের মতো বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এন্ড হিউম্যান রাইটস পার্টি থেকেই প্রার্থী হওয়ার অনুমতি পান এবং নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে উত্তর আরাকান থেকে শামসুল আনোয়ার, নুর আহমদ, মোহাম্মদ ইবরাহিম ও ফজল আহমদ নামে ৪ জন পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। বুচিডং থেকে নির্বাচিত এমপি শামসুল আনোয়ারকে অং সান সুচি ১৯৯৮ সালে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে ‘পিপলস পার্লেমেন্টে’র সদস্য করেন। এখন প্রশ্ন হলো, নাগরিক না হলে রোহিঙ্গারা এমপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করলেন কীভাবে? ভোট দিলেন কীভাবে ? রোহিঙ্গা প্রতিনিধিগণ কাদের ভোটের নির্বাচিত হয়েছিলেন ?

 

আসল কথা হলো, মুসলিম সংখ্যালঘু জনগণের বসবাসের ন্যায্যতা ও নাগরিকত্বকে অস্বীকার করে কার্যত মানবতাবিরোধী নৃশংস গণহত্যা চালাচ্ছে বর্ণবাদী মিয়ানমার। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এখন এটা স্পষ্ট, জিরো টলারেন্স নীতিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করাই হচ্ছে তাদের দীর্ঘদিনের গোপন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। বিশ্বজুড়ে প্রবল নিন্দা, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সত্ত্বেও মিয়ানমার সরকার ও সেদেশের উগ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদেরকে এহেন নিষ্ঠুর গণহত্যা ও বর্ণবাদী উগ্রতা থেকে নিবৃত্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। কার্যত মিয়ানমারে এখন নব্য নাৎসিজমের উত্থান ঘটেছে।

 

তিনি বলেন, বিশ্বমোড়ল আমেরিকা, রাশিয়া, জাতিসংঘসহ গোটা দুনিয়ার কাছে বিবেকবান মানুষের প্রশ্ন, মুসলমান হওয়াটাই কি আরাকানের নির্যাতিত নাগরিকদের অপরাধ? যে নির্যাতন আজ আরাকান-কাশ্মীরে চলছে তার শতভাগের একভাগও যদি কোনও মুসলিম দেশে অমুসলিমদের ওপর করা হতো তাহলে বিশ্বসংস্থা ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শক্তিধর দেশগুলো এভাবে নীরব ভূমিকা পালন করতো ? নিশ্চয় না।

এর তাজা দৃষ্টান্ত ইন্দোনেশিয়ার পূর্বতিমূর ও সুদানের দারফুর। দেশ দুটিতে অমুসলিমদের ওপর তেমন কোনও অত্যাচারই হয় নি বরং পান থেকে চুন না খসতেই জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে অঞ্চল দুটিকে অনেকটা চাপের মুখে স্বাধীন বা আলাদা করে দেওয়া হয়। কিন্তু নির্যাতনকারী ও আগ্রাসীশক্তি অমুসলিম আর নির্যাতিতরা মুসলমান হলে কেন ভিন্ন নীতি ? আরাকান ও কাশ্মিরের প্রশ্নে জাতিসংঘ ও বিশ্বসংস্থাগুলো অন্ধ ও বধির কেন ? নাকি মুসলমানদের কোনো মানবাধিকার থাকতে নেই।

 

আল্লামা বাবুনগরী আরো বলেন, একটি মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমাদের দাবি হলো, সারা দেশের সর্বস্তরের নাগরিক, দেশি-বিদেশি মুসলিম এনজিও সংস্থাসহ সকলের জন্য রোহিঙ্গাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো ও বিতরণের সুযোগ উন্মুক্ত রাখুন।

 

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তথা সর্বস্তরের মুসলমানদের পক্ষ থেকে অবিলম্বে মায়ানমার সরকারের গণহত্যা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। রোহিঙ্গাদের সেদেশে ফেরৎ পাঠাতে আন্তর্জাতিকভাবে মায়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য কুটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করুন। মায়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিপি কর্তৃক বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্গণ, সীমান্তবর্তী এলাকায় ভূমি মাইন স্থাপন ও বাংলাদেশের দিকে গুলি ছোড়ার যে স্পর্ধা দেখানো হয়েছে তার সমুচিত পাল্টা জবাব দিন। গোটা দেশের মানুষ সীমান্ত রক্ষী বিজিবির সাথে রয়েছে।

 

আজকের সংবাদ সম্মেলন থেকে, জাতিসংঘ, সার্ক, আসিয়ান ওআইসিসহ বিশ্বসংস্থাসমূহকে আরাকানের মুসলমানদের মানবিক অধিকার রক্ষায় কার্যকরি ভূমিকা পালন করার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার জন্য আমরা তুরস্ক সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।

 

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ও চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি মাওলানা তাজুল ইসলাম, যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা লোকমান হাকিম, যুগ্ম-মহাসচিব মুফতী ফয়জুল্লাহ, মাওলানা জুনাইদ আল হাবীব, যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা সলিমুল্লাহ, যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহী, প্রচার সম্পাদক মাওলানা আনাসা মাদানী, মাওলানা ইসহাক, মাওলানা সরওয়ার কামাল আজিজ, মাওলানা মীর ইদরীস, মাওলানা আ ন ম আহমদ উল্লাহ, মাওলানা ইউনুচ, মাওলানা রাকিবুল ইসলাম প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *