চট্টগ্রাম, , শনিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৪

admin

গ্রামের কথা

প্রকাশ: ২০১৭-০৯-১৫ ১৪:১৫:১০ || আপডেট: ২০১৭-০৯-১৫ ১৪:১৫:১০

মোহাম্মদ ইলিয়াছ : এদেশে বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। আর গ্রামের মানুষ যুক্ত থাকে নানান পেশায়। তবে গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, এদেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল এবং ৬০ ভাগ মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস হলো কৃষি।অন্যদিকে কৃষকই ঘটায় কৃষির উন্নতি। কৃষকরা থাকে গ্রামে। ধানসহ বিভিন্ন শস্য ফলায়। দেশের ৯০ ভাগ জমিতে উৎপাদিত হয় খাদ্য শস্য। আর দেশের ৭০ ভাগ জমি ব্যবহ্নত হয় ধান উৎপাদনে। ৮০ ভাগ খাদ্য কৃষকরা যোগান দেয়। কৃষকরা নানা রকম পুষ্টিকর শাকসবজি ও ফল উৎপাদন করে পুষ্টিহীনতা দূর করে। দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে রয়েছে কৃষকের অবদান। কৃষকরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে কাজ করে ফসল ফলায়। গ্রামের প্রতিটি পরিবার কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। গ্রামেই উৎপাদিত হয় শাক-সবজি। অথচ গ্রামের জনসংখ্যার অধিকাংশই অপুষ্টিতে ভুগছে। জান গেছে, শতকরা ৭০ জন মহিলা রক্তশূন্যতায় ভুগছে। এ অবস্থায়ও কৃষকের পরিশ্রমের বিনিময়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।

 

আগে কৃষকরা গরু লাঙল দিয়ে জমি চাষ করতো। ভোরের আলো না আসার আগে কৃষকরা লাঙল কাধেঁ নিয়ে ফসলের মাঠে ছুঁটে যেত। রোধে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলাতো। কোনো মজুরি ছাড়াই নিজের জমিতে-অপরের জমিতে ফসল ফলাতো। সবুজ ও জৈবিক সার প্রয়োগ করতো জমিতে। খুবই কমই ব্যবহার করতো কীটনাশক। বিরুপ প্রভাব গড়তো না পরিবেশ-প্রকৃতির উপর। দেশী ধানে ভরে যেত সারা বিল। কৃষকরা সারিবদ্ধভাবে ধান কাটতো। কৃষকরা বোঝাই বেধেঁ মাথায় ও কাঁধে করে খড়সহ ধান ঘরে তুলতো। ঘরের উঠানে কিংবা কাছারি ঘরে নারীরা পায়ে চেপে ও গরু দিয়ে ধান মাড়াই করতো। ধান মাড়াই-ঝাড়াইয়ে মিলেমিশে একে অপরকে সহযোগিতা করতো। বিনিময়ে সকলেই একত্রে খেত মুড়ি-নারিকেল কিংবা পিঠা। ঘরে নতুন নবান্ন আসলে নান রকম পিঠা তৈরীর ধুম পড়ে যেত। ঁেঢকিতে চুড়ানো হতো নতুন ধান। দেশীয় চালের ভাত খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। খাল-বিলে ছিল প্রচুর মাছ। ছিল গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ। কৃষির উপর নির্ভর করে চলতো গ্রামের মানুষ। সারি সারি ছিল মাটির ঘর-ছনের ঘর। মানুষ পায়ে হেঁটে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেত। একে অন্যের খবর রাখতো। দলে দলে পায়ে হেঁটে সাপ্তাহিক বাজারে আসা-যাওয়া করতো। একে অপরের জায়গা ব্যবহারে ছিল না কোন বিরোধ। সুন্দর পরিবেশ বিরাজমান ছিল। পরিশ্রমী ছিল মানুষ। বেশির ভাগ গ্রামীণ জনপদ ছিল মাটির। সমাজে নির্মল ও সুস্থ পরিবেশে বাস করতো গ্রামের মানুষ। এক সময় কৃষিখাত থেকে এদেশের ৭০/৭৫ ভাগ রপ্তানি আয় আসত।

 

এখন গ্রামের কৃষি পরিচালিত হচ্ছে যান্ত্রিক কাঠামোতে। ফসলের মাঠ তৈরী হচ্ছে কৃষি যন্ত্র দিয়ে। চারা রোপন, ধান মাড়াই-ঝাড়াই সবকিছু কৃষি যন্ত্র দিয়ে। চাষে দেখা যায় না লাঙল গরু। ফসলের জমিতে ব্যবহ্নত হচ্ছে প্রচুর কীটনাশক-রাসায়নিক সার। ফসলের মাঠেই বস্তা বন্ধী হচ্ছে ধান-চাল। এখন কৃষক কষ্টের ন্যায্য মূল্য পায় না। ফলে গ্রামে বিরাজ করছে ভারী পরিবেশ। খাল-বিলে পাওয়া যায় না মাছ। গ্রামে দেখা যায় না মাটি-ছনের ঘর। আধা পাকা ও দালানে ভরে গেছে গ্রামীণ জনপদ। রাখে না একে অন্যের খবর। সবাই যার-যার কাজ নেই ব্যস্ত। একটু সময় নেই কারোর। এক ইঞ্চি জায়গা নিয়ে চলে প্রতিবেশিদের মধ্যে চলে ঝগড়া-বিবাদ। কেউ কারো ছাড় দিতে চায় না। নির্মল বাতাসের পরিবর্তে পাওয়া যাচ্ছে দুষিত বাতাস। বাতাসে পাওয়া যায় মদের গন্ধ। শুনা যায় না জারি-সারি ও বাউল গান। উঠে গেছে পরষ্পরের মধ্যে সম্প্রীতি ও মায়া-মমতা। প্রতিনিয়ত মাথায় কাজ করে একে অপরকে ঘায়েল করার। অপরের সুনাম হানি করার। কেউ উপরের দিকে উঠতে চাইলে টেনে নামিয়ে ফেলে। হিংসা-বিদ্বেষে ভরা সমাজ। একে অপরের উন্নতির চেয়ে অমঙ্গল কামনা করে বেশি। হারিয়ে যেতে বসেছে সম্মানবোধ ও নীতিনৈতিকতা। দুনীর্তি ও সেচ্ছারিতায় ডুবে যাচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা। যুবক সমাজ মদের দিেেক আসক্ত হচ্ছে। প্রতিবাদের ভাষা বাধাঁগ্রস্ত হচ্ছে। অপসংস্কৃতি ঢুকছে গ্রামে।

 

শুধু কৃষির উপর নির্ভর করে চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। নানা সমস্যা জর্জরিত রয়েছে কৃষিখাত। মূলধনের অভাবে সঠিক সময়ে কৃষকরা কাজ করতে পারেনা। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নষ্ট হয় কৃষকের ফসল। ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন হয় না ভূমির ব্যবস্থা। তারপরও উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। গ্রামের মানুষের বেড়েছে জীবন-যাত্রার মান। গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট ও সড়কের আধুনিক উন্নয়ন হচ্ছে। যাতায়াত ব্যবস্থা হয়েছে সহজীকরণ। কম ও দ্রুত সময়ে মানুষ যাতায়াত করতে পারছে। গ্রামের সাথে গ্রামের যোগাযোগ ও গ্রামের সাথে শহরের যোগাযোগ হয়েছে সহজ। গ্রামীণ ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ পাচ্ছেন। সবকিছু ঠিকঠাক চললেও প্রকৃতি নষ্টের খেলায় পিছিয়ে নেই গ্রামের মানুষ। ইচ্ছামত বাড়ি-ঘর ও দোকানপাট তেরী করে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নষ্ট করছে। যেখানে-সেখানে ফেলছে ময়লা-আর্বজনা। ধ্বংস করছে পাহাড় ও গাছ। এতে সংকট হচ্ছে অক্সিজেন। বায়ুমন্ডলের বৈরী প্রভাব গ্রামীণ মানুষের মাথার উপর সবসময় ঘুরপাক খাচ্ছে। এ অবস্থায়ও উন্নয়নে অবদান রাখছে গ্রামের মানুষ ও গ্রামের কৃষক। মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে সহযোগিতা করছে।

 

লেখক: সহ: অধ্যাপক

আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *