চট্টগ্রাম, , শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

admin

মানবতার কান্না থামবে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নির্বিঘ্ন হলে  

প্রকাশ: ২০১৭-০৯-২৬ ০৯:৩২:৪৯ || আপডেট: ২০১৭-০৯-২৬ ০৯:৩২:৪৯

 

মোহাম্মদ ইলিয়াছ: রোহিঙ্গা মিয়ানমারের একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম। মিয়ানমারের রাখাইনরাজ্যে এদের আবাসস্থল। এ রাজ্যের এক–তৃতীয়াংশ অধিবাসী হলো রোহিঙ্গা।এরা বেশির ভাগই মুসলমান। কালের বিবর্তনে ক্রমিক বর্বর আক্রমণের শিকারহয়ে বহু রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ,পাকিস্থান,থাইল্যান্ড, নেপাল, ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যসহবিভিন্ন দেশে চলে গেছে। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে যে সব রোহিঙ্গা আছে তাদেরউপর নানভাবে সরকারি বাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতন চলছে। নির্যাতনে শিশু ওনারী–পুরুষসহ অনেক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে। জ¦ালিয়ে দেয়া হয়েছে তাদেরঘর–বাড়ি। বাঁচার তাগিদে ইতিমধ্যে প্রায় ৫ লক্ষ রোহিঙ্গা আমাদের দেশে আশ্রয়নিয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। অধিকাংশ রোহিঙ্গা খাদ্যসংকটে রয়েছে।

ইতিহাসবিদদের মতে, আরবি শব্দ “রহম”। যার অর্থ দয়া করা। রহম শব্দ থেকেরোহিঙ্গা শব্দের উৎপত্তি। খ্রিষ্টীয় ৮ম/৯ম শতাব্দীতে চন্দ্রবংশীয় রাজারাআরাকান শাসন করতো। এ বংশের রাজা মহত ইং চন্দ্রের রাজত্বকালেআরবের বাণিজ্য জাহাজ রামব্রি দ্বীপের তীরে এক সংঘর্ষে ভেঙে যায়।জাহাজের আরবীয় মুসলমানরা ভাসতে ভাসতে তীরে এসে “রহম” “রহম” শব্দউচ্চারণ করে স্থানীয়দের সাহায্য কামনা করে। পরবর্তীতে রহম শব্দটি বিকৃতহয়ে রোয়াং হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানেররাজধানী ম্রোহাং থেকে। রাখাইন রাজ্যের আদি নাম আরাকান। ম্রোহাং শব্দটিবিকৃত হয়ে রোয়াং, রোহাংগ, রোসাংগ ও রোহিঙ্গা শব্দ হয়েছে। (সূত্র: রোহিঙ্গাজাতির ইতিহাস–এন.এম. হাবিব উল্লাহ)

উইকিপিডিয়া বিশ^কোষ থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গা মিয়ানমারের আদিবাসীজনগোষ্ঠী। ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত এ জনগোষ্ঠী পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইনরাজ্যে বসবাসরত। অষ্টম শতাব্দীতে আরাকানে (রাখাইন রাজ্য) মুসলমানদেরবসবাস শুরু হয়। এ অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠীই রোহিঙ্গা নামেপরিচিতি লাভ করে। সতেরো শতকের দিকে আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৭৮৫ সালে বার্মিজরা দখল করে নেয় আরাকান। তখনবার্মিজ শাসকরা আরাকানের হাজার–হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং বড়একটা অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে।

রোহিঙ্গা নির্যাতন নতুন কোন ঘটনা নয়। তাদের উপর নির্যাতন ইতিহাস বহুপুরনো দিনের। রোহিঙ্গারা সর্বপ্রথম নিপীড়নের শিকার হয় ১৭৮৪ সালে। সেসময়ের রাজা আরাকান দখল করে নেয় এবং বহু রোহিঙ্গাকে হত্যা ওবিতাড়িত করে। রোহিঙ্গারা বড় ধরণের নিপীড়নের শিকার হয় ১৯৪২ সালে।তখন জাপানীরা বার্মা দখল করে বহু রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করে।এ সময়ে অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। ১৯৪৮ সালেমুসলিম বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। মুসলিমঅধ্যুষিত গ্রামগুলো জ¦ালিয়ে দেয়া হয়। ১৯৬৪ সালে রোহিঙ্গাদের সবসামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৫ সালে রোহিঙ্গাভাষার সব অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়। ১৯৭৩–১৯৭৪ সালে রোহিঙ্গা উচ্ছেদঅভিযান চালানো হয়। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বহু রোহিঙ্গাদেরউপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়। ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৯০ সালে আবারো রোহিঙ্গাউচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। ১৯৯১-‘৯২ সালে বহু রোহিঙ্গাকে হত্যা ও নির্যাতনেরশিকার হতে হয়।

২০১২ সালে রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলিম ও বৌদ্ধ রাখাইনদের মধ্যেজাতিগত কোন্দলকে কেন্দ্র করে শুরু হয় দাঙ্গা। ২০১৫ সালে রোহিঙ্গাদেরভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়। রাখাইন রাজ্যে এভাবে রোহিঙ্গাদের উপর ক্রমিকনির্যাতনের ফলে বহু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শেষ হয়ে যায় এবং প্রায় ১০ লক্ষরোহিঙ্গা বিভিন্ন দেশে চলে যায়। সর্বশেষ গত ২৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাতএকটার দিকে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা রাখাইন রাজ্যের ৩০টি পুলিশ চেক পোস্ট ওএকটি সেনাঘাঁটিতে হামলা চালালে মিয়ানমারের এক সেনাসদস্যসহ ১২জননিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। বার্তা সংস্থা এএফপি এর মতে এ ঘটনায়৭৭ রোহিঙ্গা বিদ্রোহী নিহত হয়েছে। এর জের ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীরাখাইন রাজ্যে নতুন করে “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” শুরু করে। রাখাইন রাজ্যেরোহিঙ্গাদের উপর চলে নির্যাতন ও হত্যাকা–। শত শত রোহিঙ্গা নিহত ও নারীরাধর্ষণের শিকার হয়েছে। নির্যাতনের মাধ্যমে দেশান্তরিত হতে বাধ্য করা হচ্ছে।

বিভিন্ন দেশী–বিদেশী মিড়িয়ার খবর থেকে জানা গেছে, ঘটনার পর থেকেরাখাইন রাজ্যে বহু সবল পুরুষদেরকে বেছে বেছে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে।প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গাদের ঘর–বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতেআরাকানে ফিরে যেতে না পারে তার জন্য সীমান্তে বিপুল সংখ্যক মাইন ও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক বসানো হয়েছে। বাংলাদেশ, তুরষ্ক, মালয়েশিয়া ওইরানসহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গাদের উপর এহেন নির্যাতনের নিন্দা ওরাখাইন রাজ্যে সহিংসতা বন্ধ করতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহবানজানিয়েছে। তারপরও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর চলছে অমানবিকআচরণ। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর যুগে–যুগে চলেছে নির্যাতন ও মানবতারঅবমাননা। জাতি–গোষ্ঠী, চেহারা ও ভাষার দোহাই তুলে নাগরিকত্ব থেকেবঞ্চিত করা হয় রোহিঙ্গাদের। যখন–তখন সম্পত্তি কেড়ে নেয়া হয়। জোর করেশ্রমে নিয়োগ দেয়া হয়। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে লাগে ভিসার মতোঅনুমতিপত্র। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় গ্রামের বাইরে থাকলেপ্রশাসনে রক্ষিত পরিবারের সদস্য তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়া হয় এবংমিয়ানমার থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। পাস ছাড়া স্কুল–কলেজে যেতেদেয়া হয় না।

অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য রয়েছে বিবাহ নিয়ন্ত্রণ আইন। বিয়ে করতে চাইলেশহর বা গ্রাম প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সামরিক প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হয়এবং ফি সহকারে আবেদন করতে হয়। অনুমতি ছাড়া বিয়ে করলে ১০ বছরেরকারাদন্ড দেয়া হয়। এমন বহু মানবাধিকার লঙনের আইন রয়েছে রোহিঙ্গাদেরউপর। এমন একটি মগের মুলুকের দেশ মিয়ানমার। বাংলা একাডেমি মগেরমুলুøুক নিয়ে লিখেছে– ব্রম্মদেশ বা আরাকান রাজ্য এবং ্অরাজক দেশ। যেরাজ্যে আইনের শাসন ভাল না। নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িঘর জ¦ালিয়েদেয়া নাকি বার্মিজদের পুরনো অভ্যাস। (সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ,৮ সেপ্টেম্বর২০১৭)।

বর্তমানেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ নির্যাতনআর চলতে দেয়া যায় না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভাবা ও মিয়ানমারে রাখাইনরাজ্যে তাদের ফিরিয়ে নেয়া এখন জরুরী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারেতাদের নাগরিকত্ব প্রধানসহ তাদের বাড়িঘর ফিরিয়ে দেয়া উচিত। বিশে^রশক্তিধর দেশগুলোকে মিয়ানমারকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। জাতিসংঘকেমাথা ঘামাতে হবে। রাখাইন রাজ্যের জন্য গঠিত“অ্যাডভাইজরি কমিশন”রাখাইনে হামলার মাত্র একদিন আগে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদেরনাগরিকত্ব প্রদানসহ মৌলিক আধকার রক্ষার জন্য আহবান জানিয়েছিলেন।মিয়ানমারের সরকারের কাছে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা বন্ধ ও শান্তি বজায়রাখতে আহবান জানিয়েছেন বিশ^ নেতৃবৃন্দ। তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। বরঞ্চমিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের উপর অমানবিকনির্যাতন করে যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। মিয়ানমারের শাসনভার যারহাতে ন্যস্ত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সাং সুচি সাধারণ রোহিঙ্গাদের পক্ষেদাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেনি। রোহিঙ্গারা অপরাধ করলে আইনেরআওতায় আনতে পারতেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদেরকে নির্বিচারে নির্যাতন ও হত্যাএবং দেশ থেকে বের করে দেয়ার প্রক্রিয়া কারোর জন্য শুভ নয়।

জাতিসংঘ, ওআইসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে অবিলম্বে পদক্ষেপগ্রহণ করা উচিত। রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশে^র সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী এবিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে চাপ সৃষ্টি করতে হবে মিয়ানমার সরকারকে।দ্রুত কুটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা হওয়া দরকার। কেননা রোহিঙ্গাদের এখনবহুমুখী মানবিক সমস্যা। তারা এখন সহায় সম্বলহীন অসহায় শরণার্থী। যেখানেঅধিকাংশই মহিলা–শিশু। রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্তচাপের বিষয়। তারপরও আমাদের দেশের সরকার ও জনগণ তাদেরকেসহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। এদেশের বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে। কিন্তু তাদেরকে স্থায়ীভাবেভরণ–পোষণ করা এদেশের জন্য কঠিন। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে দ্রুত স্থায়ীসমাধান করা দরকার। বিশ^ সম্প্রদায়কে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফিআনান কমিশন রির্পোট ও সুপারিশ বাস্তবায়ণসহ দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করাউচিত।

 

লেখক : শিক্ষাবিদ, আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ,লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *