admin
প্রকাশ: ২০১৭-১০-০১ ২০:৪৪:২৩ || আপডেট: ২০১৭-১০-০১ ২০:৪৪:২৩
মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.): একটা কথা এখন নিশ্চিত হয়ে বলা যায়, গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে যা ঘটছে তার পরিণতিতে অপার সম্ভাবনাময় মিয়ানমার রাষ্ট্রটিকে চীনের দাবার ঘুঁটি হয়ে থাকতে হবে বহু দিন। অগণতান্ত্রিক, জবাবদিহিহীন, ব্রুটাল এবং একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দানবীয় শক্তির অধিকারী চীনের মতো একটি রাষ্ট্রের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ হয়ে গেল মিয়ানমার সাম্প্রতিক এ ঘটনার মধ্য দিয়ে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যেমন অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থায় কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য সে দেশের ইসলামিস্ট মোল্লাদের সঙ্গে মিত্রতা করে পাকিস্তানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে, ঠিক একইভাবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাও বৌদ্ধ মোল্লাদের সঙ্গে মিত্রতা করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মিয়ানমারকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বার্ট্রান্ড রাসেল তার বিখ্যাত বই ‘দ্য কংকুয়েস্ট অব হ্যাপিনেস গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন, ‘ধর্মের উসকানি দিয়ে মানুষকে যত সহজে দলে ভেড়ানো যায়, অন্য কিছুর দ্বারা তা সম্ভব হয় না। ’ আজ বিশ্বের দিকে তাকালে সর্বত্রই রাসেলের কথার প্রমাণ মেলে। সব দেশের সামরিক শাসকরা ধর্মের আশ্রয় নিয়ে এমনটাই করেন। ভাগ্যিস বাংলাদেশের মানুষ দুই সামরিক শাসকের কবল থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। তা না হলে আমাদের দশাও আজ এমনই কিছু একটা হতো।
এটা এখন স্পষ্ট, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটো ক্ষমতায় বলীয়ান হয়েই মিয়ানমার এত বড় গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালাতে সাহস পেয়েছে। তা না হলে গত শতকের নব্বই দশকের শেষ দিকে কসোবো ইস্যুকে কেন্দ্র করে সার্বিয়ার যে করুণ অবস্থা হয়েছিল, মিয়ানমারকেও এতদিনে সেই ভাগ্যই বরণ করতে হতো। ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ, করপোরেট বাণিজ্য স্বার্থ এবং ক্ষমতার অন্ধত্ব কত বড় নির্মম ও নিষ্ঠুর হতে পারে তার আরেকটি নতুন জ্বলন্ত উদাহরণ সৃষ্টি হলো রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে। আর সেটি সম্মিলিতভাবে সৃষ্টি করল চীন ও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। কিন্তু মানবতার ওপর এত বড় নিষ্ঠুরতার প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে চীন, মিয়ানমার কেউই রক্ষা পাবে না। ইতিহাস এমন কথাই বলে। গত চার সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নে আমার কাছে মনে হচ্ছে চীন তার ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অপরিহার্যতার বিবেচনা থেকে মিয়ানমারকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসতে চেয়েছে যাতে আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কোনোভাবেই যেন কোনো প্রভাব প্রতিষ্ঠার সুযোগ না পায়। বলা যায়, চীনের এই লক্ষ্য ইতিমধ্যে অর্জিত হয়ে গেছে। চীন এই লক্ষ্য অর্জন করার জন্য পরম মিত্র পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কাজে লাগিয়েছে।
সংগত কারণেই মিয়ানমারের প্রতি ক্ষুব্ধ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি অংশের ভিতর থেকে গড়ে ওঠা সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সংযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা বহু দিনের। সে রকমই একটি জঙ্গি সশস্ত্র সংগঠন আরসা গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ৩০টি ফাঁড়ির ওপর একসঙ্গে আক্রমণ চালায়। এর পাল্টা হিসেবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গত এক মাস ধরে যা করছে তাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ অন্য সব সংশ্লিষ্টকে, সেটা আজ হোক বা কাল হোক। কম্বোডিয়ার গণহত্যাকারী কমিউনিস্ট শাসক পলপট ও তার সঙ্গীদের বিচারের হাত থেকে চীন শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে না পারলেও প্রায় ২৫ বছর তা ঠেকিয়ে রেখেছিল। মিয়ানমারের অপরাধীদের আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারের হাত থেকে কত দিন রক্ষা করতে পারবে, সে প্রশ্নটি থাকলেও চীনের ভূমিকায় স্পষ্ট হয়েছে সে চেষ্টা তারা করবেন এবং মিয়ানমারের জন্যও চীনের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রবল প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। দুই পক্ষেরই ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের মাত্রা অনেক বেশি। চীনের অর্থ-বাণিজ্যের লাইফ লাইন হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগর এবং এই দুইয়ের সংযোগকারী মালাক্কা প্রণালি। মানচিত্র সামনে নিয়ে বসলেই বোঝা যায়, দুই পরাশক্তির যে কোনো সামরিক সংঘর্ষের মুখে চীনের এই লাইফ লাইন ভয়ানক হুমকির মধ্যে পড়বে। তাই এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি ও ঘাঁটিগুলোর অবস্থানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, চীন এখন ভারত মহাসাগরে পৌঁছার অন্তত একটি পথ ও দরজা নিশ্চিত রাখার জন্য মরিয়া। সেটি হতে পারে যদি মিয়ানমারের ওপর চীনের একক আধিপত্য ও কর্তৃত্ব বলিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সম্প্রতি গণহত্যা চীনকে এই সুযোগ করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাঠগড়া থেকে দূরে থাকতে চাইলে এখন থেকে চীনের সব দাবিই মিয়ানমারকে বিনাশর্তে মেনে নিতে হবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্য এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সংগৃহীত দলিল দস্তাবেজ যথেষ্টভাবে সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে প্রমাণ করবে রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। রাখাইন অঞ্চলে ঢুকে বাধাহীন তদন্ত করতে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব পালনকারী তদন্ত দল। দাবিটি এমন সময়ে করা হয়েছে যখন স্যাটেলাইট কর্তৃক ধারণকৃত তথ্যচিত্রের ওপর ভিত্তি করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিবৃতি দিয়েছে, ২১৪টি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রাম মিয়ানমার সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে। এএফপি সূত্রের খবরে প্রকাশ, জাতিসংঘের তদন্ত দলের প্রধান মারজুকি দারুসম্যান বলেছেন, রাখাইনে ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্যয়ের খবর আছে, যার প্রতি জরুরি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। যুক্তরাজ্য মিয়ানমারের সঙ্গে সব ধরনের সামরিক সহযোগিতা স্থগিত এবং চলমান জাতিগত সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাত্রেঁদ্ধা বলেছেন, চার লাখের ঊর্ধ্বে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াই প্রমাণ করে, সেখানে জাতিগত নিধন হচ্ছে। সুতরাং গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের প্রমাণ এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে আছে। আর এর জন্য প্রধানত ও এক নম্বরে দায়ী হবেন মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইয়াং এবং তার অপর তিন জেনারেল যারা যথাক্রমে দায়িত্বে রয়েছেন প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। এদের সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে যারা সেনা অভিযান পরিচালনা করেছেন তারাও অভিযুক্ত হবেন। সর্বকালে সব দেশের সেনাশাসকদের একটা কমন চরিত্র লক্ষণীয়। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকে জায়েজ করার জন্য এমন সব কাজ তারা করেন যেটি এক সময়ে তাদের জন্য হয়ে ওঠে সেই বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার গল্পের মতো অবস্থা। বাঘের পিঠ থেকে নামলে আর রক্ষা নেই। তাই তারা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যা কিছু করা সম্ভব তা করেন, তাতে রাষ্ট্র ও দেশের মানুষের কী হলো তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত ৫৫ বছর মিয়ানমারের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ভার্সেস উন্নয়নের অধোগতির পরিসংখ্যান দেখলেই উপরোক্ত কথার সত্যতা পাওয়া যায়। উন্নয়ন হয়েছে শুধু সেনাবাহিনী ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের দেশে সেনাবাহিনীর সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ, যা জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। সুতরাং মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কেবল আন্তর্জাতিক আদালতের শাস্তি এড়ানোর জন্য দেশের পথঘাট, সড়ক, রেল, সমুদ্র বন্দর, বনজ ও খনিজ সম্পদ সব কিছু চীনের করপোরেট ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেবেন। মিয়ানমারের সার্বভৌমত্ব বলতে অন্তত চীনের কাছে আর কিছু থাকবে না। বৃহত্তর জনগণ যে তলানিতে আছে সেই তলানিতেই থেকে যাবে। দেশের ভিতরের জাতিগত সমস্যা সামরিক পন্থায় সমাধান করতে গিয়ে একটি রাষ্ট্র কীভাবে বিপদগ্রস্ত হয় এবং বৃহৎ শক্তির হাতের মুঠোয় চলে যায় তার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার উত্তরে তামিল জাতিগোষ্ঠী কেন্দ্রিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত এতদঞ্চলের মধ্যে মানব উন্নয়নের সব সূচকে সবচেয়ে ঊর্ধ্বে ছিল শ্রীলঙ্কা। রাজনৈতিক কূটনৈতিক পন্থায় সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়ে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় সরকার তামিল বিদ্রোহীদের পরাজিত করার জন্য পুরো তামিল জাতিগোষ্ঠীর এলাকায় সর্বাত্মক সামরিক অভিযান চালায়। তাতে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী সফলতা পায়। তামিল বিদ্রোহীরা পরাজিত হয় এবং পুরো অঞ্চলের ওপর শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু উল্টোপথে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করলে যা হওয়ার তা-ই হলো। এক সমস্যার আপাতত সমাধান হলেও অন্য দিক থেকে আরও প্রকট সমস্যার সৃষ্টি হলো। এতদিনের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে। জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিশ্বের তাবৎ মানবাধিকার সংস্থাগুলো অকাট্য প্রমাণাদিসহ শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে, সেনাপ্রধান এবং অন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করে। নিশ্চিত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর হাত থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী চীনের দ্বারস্থ হয় প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের শ্রীলঙ্কা সরকার। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, অগণতান্ত্রিক ও জনগণের মতামতের তোয়াক্কাহীন চীন এসব ক্ষেত্রে যতটুকু করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশ ততখানি করতে পারবে না। কারণ, ওইসব দেশের সরকারকে এক সময় এসে জনগণের দাবির কাছে হার মানতে হয়। এটাই গণতন্ত্রের শক্তি ও সৌন্দর্য। শ্রীলঙ্কার বিষয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের আন্তর্জাতিক আদালতের হাত থেকে রক্ষা করতে চীন এগিয়ে এলো ঠিকই, কিন্তু তা কি খালি হাতে হয়েছে? অনেক দেন-দরবারের পর এই মাত্র কিছু দিন আগে ২০ হাজার একর জমিসহ হ্যাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে লিজ প্রদানের দলিল স্বাক্ষর করেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। কিন্তু ‘আমারি বধুয়া আন বাড়ি যায় আমারি আঙিয়া দিয়া’, তা কেমন করে হয়। সুতরাং অপর বড় সমুদ্র বন্দর ত্রিংকোমালি এখন ভারতের হাতে। এবার তাহলে বুঝুন আগামী দিনের জন্য কী ভাগ্য অপেক্ষা করছে মিয়ানমারের জন্য। একটা বিপুল বিশাল সম্ভাবনাময় দেশকে ক্ষমতাসীন জেনারেলরা শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য একেবারে শেষ করে দেওয়ার পথে হাঁটছে। ধরা পড়েছে চীনের পাতা ফাঁদে।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
সূত্র – বাংলদেশ প্রতিদিন