চট্টগ্রাম, , মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

Alauddin Lohagara

ডায়াবেটিস সমাচার

প্রকাশ: ২০১৭-১২-১৭ ২২:০০:১২ || আপডেট: ২০১৭-১২-১৭ ২২:১৪:৩৬

ডাঃ মোহাম্মাদ লোকমান:

বর্তমান বিশ্বের বহুল পরিচিত এবং আলোচিত একটি রোগের নাম ডায়াবেটিস। সভ্যতার ক্রমোন্নতির সাথে পাল্লা দিয়ে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যাও দিনদিন বাড়ছে।

কায়িক পরিশ্রম বাদ দিয়ে মানুষ যত বেশী যন্ত্র নির্ভর হচ্ছে, তত বেশী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। একসময় বড়লোকদের অসুখ হিসেবে ডায়াবেটিসের পরিচিতি থাকলেও এখন ধনী-গরীব কেউ রেহাই পাচ্ছেনা এই জটিল রোগ হতে। বলতে গেলে এখন ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস রোগী। আমাদের দেশে বর্তমানে এক কোটিরও বেশী মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত, যাহা জনস্বাস্থ্যের জন্যে নিঃসন্দেহে একটি বড় হুমকি।

 

ডায়াবেটিস কি?

ডায়াবেটিস একটি বিপাক জনিত রোগ।

আমাদের শরীরে ইনসুলিন নামক একধরনের হরমোন রয়েছে, যার কাজ হচ্ছে রক্তের গ্লুকোজকে কোষের অভ্যন্তরে পৌঁছে দেয়া। এই ইনসুলিনের ঘাটতির কারনে অথবা ইনসুলিন ঠিকমত কাজ করতে না পারার কারনে, বিপাকজনিত গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং অতিরিক্ত গ্লুকোজ প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে আসে। এই সামগ্রিক অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলে। এটি কোন ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয় কিন্তু সারাজীবনের রোগ।

 

ডায়াবেটিসের লক্ষণ:

-ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া

-খুব বেশী পিপাসা লাগা, গলা শুকিয়ে যাওয়া

-বেশী ক্ষুধা পাওয়া

-যথেষ্ঠ খাওয়া সত্ত্বেও দিনদিন ওজন কমে যাওয়া

-সবসময় ক্লান্তি ও দুর্বলতা বোধ করা

-ক্ষত শুকাতে দেরী হওয়া

-খোশ-পাঁচড়া,ফোঁড়া ইত্যাদি চর্মরোগ দেখা দেওয়া

-চোখে কম দেখা

-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

উপরোক্ত লক্ষণ সমুহ না থাকলেও সাইলেন্ট কিলার হিসেবে যে কারো ডায়াবেটিস থাকতে পারে। বিশেষ করে যাদের বয়স ৪০ এর উপরে, যাদের গোষ্ঠীতে ডায়াবেটিস রোগী আছে, যারা মোটেও শারীরিক পরিশ্রম করেনা এবং যাদের উচ্চতার তুলনায় ওজন বেশী, কোন লক্ষণ না থাকলেও তাদেরকে অবশ্যই ডায়াবেটিস পরিক্ষা করানো উচিৎ, প্রতি ৩ মাস পরপর।

 

রক্তের সুগার কত হলে বুঝবেন আপনার ডায়াবেটিস?

 

সকালে খালি পেটে রক্তে চিনির মাত্রা যদি ৫.৮ মিলিমোল/লিটার এর চেয়ে কম থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে আপনার ডায়াবেটিস নেই। কিন্তু যখন চিনির মাত্রা ৫.৮ এর বেশি অথচ ৭.৮ মিলিমোলের কম হয় তখন বুঝতে হবে আপনার ডায়াবেটিস হওয়ার বেশ ঝুঁকি আছে। এটাকে বর্ডার লাইন ডায়াবেটিস বলে ধরা হয়।

আর যখন খালিপেটে রক্তে চিনির মাত্রা ৭.৮ মিলিমোলের বেশি হয়, তখন বুঝে নিতে হবে আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

আহারের ২ ঘন্টা পর যদি রক্তের সুগারের মাত্রা ৭.৮ এর উপরে কিন্তু ১১.১ এর নিচে থাকে, তখনও বুঝতে হবে আপনি ডায়াবেটিসের বেশ ঝুঁকিতে আছেন। আর যদি আহারের ২ ঘন্টা পর সুগার ১১.১ এর উপরে থাকে, তখন বুঝতে হবে আপনি একজন ডায়াবেটিস রোগী।

 

ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ:

ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকার-

 

টাইপ-১ ডায়াবেটিস:

এক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। এধরনের রোগীর শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন একবারেই হয়না বা উৎপাদিত হলেও তাহা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তাই রোগীকে বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নেয়ার কোন বিকল্প থাকেনা। এটি সাধারণত বংশগত ভাবেই হয়। শিশু ও তরুণদের মধ্যে এ ধরনের ডায়াবেটিস   বেশি হয়। সাধারণত এটি ১০-৩০ বছরের মধ্যে দেখা দেয়। এটি মূলত জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে।

HLADR 3 এবং HLADR 4 নামক দুটি জিন এই ডায়াবেটিসের জন্যে দায়ী।

 

টাইপ-২ ডায়াবেটিস:

এই রোগের পেছনে থাকে মূলত ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স’। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা শরীরে উৎপাদিত ইনসুলিন ঠিকমত ব্যবহার করতে পারে না। ব্যায়াম ও খাদ্যবিধির সাহায্যে একে প্রথমে মোকাবিলা করতে হয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় মুখে খাওয়ার ওষুধ, এমনকি ইনসুলিন ইনজেকশন। ৪০ বছর বয়সের পর সাধারণত এই রোগ দেখা দেয়। মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্য, অতিরিক্ত চর্বি জাতিয় খাদ্য, অত্যধিক পরিমাণ সাদা ভাত খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম না করা ইত্যাদি  টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ। বিশ্বজুড প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ শতাংশেরও বেশি হল টাইপ-২ ডায়াবেটিস।

 

এছাড়া জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস নামে আরেক ধরনের ডায়াবেটিস আছে,যাহা গর্ভাবস্থায় দেখা দেয়।

বাচ্ছা ডেলিভারি হয়ে যাওয়ার পর সাধারণত এটি ভাল হয়ে যায়।

 

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা সমুহ:

জীবনঘাতী বেশিরভাগ মারাত্মক রোগ সমুহের জননী বলা হয় ডায়াবেটিসকে।

–টাইপ-১ বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিসে ইনসুলিন না নিলে রক্তের সুগার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়ে অতি দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ঘন ঘন শ্বাস, বেশি প্রস্রাব, বমি, পেটব্যথা, পানিশূন্যতা, পরিশেষে জ্ঞান হারানো এবং কখনো কখনো মৃত্যু। এ অবস্থার নাম ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস।

 

অন্যান্য জটিলতাসমূহঃ

-ব্রেইন স্ট্রোক:ডায়াবেটিস রোগীর ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ২ থেকে ৩ গুন বেশি।

– দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া এমনকি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ লোকের তুলনায় দশ গুন বেশি।

-হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের ঝুঁকি সাধারণ লোকের তুলনায় ৩ থেকে ৪ গুন বেশি।

– কিডনি বিকল হওয়া: ডায়াবেটিস রোগীদের শতকরা ১৭ ভাগই কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়। এবং তারমধ্যে অর্ধেকেই কিডনী বিকল হয়ে অকালে মারা যায়।

– পায়ে পচন ধরা বা গ্যাংগ্রিন: দূর্ঘটনা ছাড়া যত লোকের পা কেটে ফেলতে হয় তার অর্ধেকের বেশী ডায়াবেটিস রোগী।

-মহিলাদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা, অত্যধিক মোটা এবং মৃত সন্তান জন্মদানের প্রবণতা বাড়তে পারে।

– এছাড়া ডায়াবেটিসের কারণে অত্যধিক দূর্বলতা, অবসাদ এবং যৌন অক্ষমতার জন্য জীবনের মূল্যবোধ কমে যায়।

 

ডায়াবেটিস হতে বাঁচার উপায়:

আমরা সবাই বেশ আর কম ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিতে আছি। তবে কিছু নিয়ম মেনে চললে এই ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।

ওজন কমান:

ডায়াবেটিসের একটি অন্যতম কারণ হল অতিরিক্ত ওজন। ওজন যত বাড়তে থাকবে ততই বাড়বে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি। তাই ডায়াবেটিস হতে দুরে থাকতে চাইলে ওজন নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।

 

ফাইবার জাতীয় খাবার বেশি খানঃ-

খাবারের তালিকায় যত বেশি সম্ভব ফাইবার জাতীয় খাবার রাখুন। যেমন ফল, সবজি, দানা জাতীয় শস্য, বাদাম ইত্যাদি। ফাইবার জাতীয় খাবার বেশি খেলে তা শরীরে শর্করার শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

 

নিয়মিত শরীরচর্চা করুন:

ডায়াবেটিস থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। দিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট দ্রুত হাটার অভ্যাস করতে হবে। এতে ওজন যেমন নিয়ন্ত্রণে থাকে তেমনই শরীরে ইনসুলিন সঠিক ভাবে ব্যবহার হয়। ফলে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়।

 

ধূমপান বন্ধ করুনঃ-

আপনি যদি ডায়াবেটিস থেকে বাঁচতে চান তবে এখনই বন্ধ করুন ধূমপান। ধূমপান কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা।

 

খাবারের পরিমাণ কমানঃ-

মাত্রাতিরিক্ত আহার ডায়াবেটিসের একটি অন্যতম কারণ। তাই খাবারের পরিমাণ কমাতে হবে।

 

মানসিক চাপমুক্ত থাকুনঃ-

মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপ রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই মানসিক চাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। দৈনিক ৬ থেকে ৭ ঘন্টা ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে।

 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়:

ডায়াবেটিস কোন নিরাময়যোগ্য রোগ নয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। একে সারাজীবনের রোগ বলা হয়।

কিছু নিয়ম মেনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধ চালিয়ে গেলে, কোন রকম জটিলতা ছাড়া সারাজীবন ভাল থাকা সম্ভব।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূলনীতি হচ্ছে- ত্রি ডি অর্থাৎ ডায়েট, ডিসিপ্লিন এবং ড্রাগস।

-ডায়েট কন্ট্রোল: শর্করা জাতিয় খাবার যেমন ভাত, যাবতীয় মিস্টি জাতিয় খাদ্য(চিনি, গুড়, মধু, জেম-জেলি,সন্দেশ,রসগোল্লা ইত্যাদি), কোমল পানিয়, ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত চর্বি জাতিয় খাদ্য ইত্যাদি কম খাওয়ার অভ্যাস করা। শাকসবজি সহ যাবতীয় ফাইবার জাতিয় খাবার বেশী খাওয়ার অভ্যাস করা। ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক খাদ্যতালিকা মেনে চললে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা একদম সহজ।

-ডিসিপ্লিন অর্থাৎ নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের চেষ্টার মাধ্যমে ডায়াবেটিস সহ যাবতীয় সারাজীবনের রোগ সমুহ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাটার অভ্যাস করা,

মুখের এবং পায়ের যত্ন নেয়া, সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করা, অসুস্থ হলে সাথেসাথে ডাক্তার দেখানো, ইত্যাদি বিষয় সমুহ সবসময় গুরুত্ব দিতে হবে।

-ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিন অথবা মুখে খাওয়ার ওষুধ সমুহ নিয়মিত সেবন করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন অবস্থাতেই ওষুধ বন্ধ করা যাবেনা।

 

ডায়াবেটিস হতে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্যলাভ করার মত কোন মেডিসিন আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি, ভবিষ্যতেও হয় কিনা সন্দেহ। তবে এই রোগটি নিয়ে আতংকিত হওয়ারও কিছু নেই। একটু সচেতনতা অবলম্বন করে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে একজন সুস্থ মানুষের মতই জীবন কাটিয়ে দেয়া সম্ভব। আসুন আমরা সচেতন হই, ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। নিয়মিত পায়ে হাটার অভ্যাস করি, সুষম খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হই এবং জীবনযাপনে একটি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি।

আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে সুশৃঙ্খল এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবন কাটানোর মাধ্যমে ডায়াবেটিস সহ যাবতীয় জীবনঘাতী রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার তাওফিক দান করেন।

 

লেখক; মেডিকেল অফিসার

চকরিয়া পৌরসভা,

চকরিয়া, কক্সবাজার।

প্রিয় লোহাগাড়া ম্যাগাজিনের বিজয় দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *