চট্টগ্রাম, , বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

কাইছার হামিদ

বিজয়ের গল্প গাথা-৫

প্রকাশ: ২০১৯-১২-০৫ ০৯:৫৮:৩৫ || আপডেট: ২০১৯-১২-০৫ ১০:০০:৫৮

কাইছার হামিদ- ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো সারাদিন অবাধে আকাশে উড়ে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। অকেজো করে দেয় বিমান বন্দরগুলো। বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর অধিকাংশ বিমান। পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয়ের উপর ভারতীয় জঙ্গি বিমান আক্রমণ চালায়। এতে পাক বাহিনীর ৯০টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্য বোঝাই কয়কেটি লঞ্চ ধ্বংস হয়।

বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমণে ধ্বংস হয় পাকিস্তানি সাবমেরিন গাজী। এ সাবমেরিনটি  পাকিস্তানকে ধার দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এদিন নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সব নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের নির্দেশ দেয়। যৌথবাহিনী তাদের  হুশিয়ারি দিয়ে বলেন যে আপনারা সবাই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে চলে যান। এতে কাজ হলো। বিশ্বের সব দেশ বুঝল বংলাদেশের বন্দরগুলো রক্ষা করার কোনো ক্ষমতা পাক বাহিনীর নেই। এ সুযোগে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ও বিমানগুলো সব বন্দরকে ঘায়েল করার সুযোগ ও পেয়ে গেল। 

এদিকে তখন স্থলেও মিত্রবাহিনীও এগিয়ে যাচ্ছে। পাক বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। ভারতীয় বাহিনীর প্রধান সড়কগুলো অবরোধ সৃষ্টি করার ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং রংপুর আর যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। 
এখানে পাকবাহিনী মিত্র বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্নসমর্পণ করে। ফলে আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহী আমীর হোসেন, লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান, সিপাহী রুহুল আমীন, সিপাহী সাহাব উদ্দীন ও সিপাহী মুস্তাফিজুর রহমান শহীদ হন। এদিন ১৬০ জন পাকিস্তানী সৈন্য মিত্রবাহিনীর হাতে নিহত হয়। একাত্তরের এই দিনে বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন ছিল আরও উত্তপ্ত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রধান লড়াইটা ছিল দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। 

বাংলাদেশের পক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পাকিস্তানের পক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে ফের যে অধিবেশন বসে তাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের এক প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তি’ প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘটবে এবং পাক বাহিনীর সহিংসতার কারণে পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছে তাও অবিলম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন। একমাত্র পোল্যান্ড প্রস্তাবটি সমর্থন করে। আর চীন প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট দেয়। অন্য সদস্য দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ওই দিন আরও আটটি দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে আরেকটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয়বারের মতো ভেটো দেয়। একই সময়ে বার্তা সংস্থা ‘তাস’ মারফত এক বিবৃতিতে সোভিয়েত সরকার ‘পূর্ব বাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে’ সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানায়। 

এই দিন জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি বলেন, কোনো শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চউএন লাই ভারতীয় হামলার মুখে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার কথা বলেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তপ্ত অবস্থা চিন্তিত করে তোলে প্রবাসী সরকারকে। কারণ এদিনও ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব শ্রী কেবি লাল ‘বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা বলে’ উল্লেখ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন। 

রাজনৈতিক এ পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের যাতে দুর্বল না করে তোলে তাই মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন। এদিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর  শাসক গভর্নর ডা. মালিক দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। তিনি বলেন, ‘দেশ আক্রান্ত। ভারতীয়দের সহযোগিতায় কিছু বিশ্বাসঘাতক দেশ আক্রমণ করেছে। এ দেশের সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করছে। তাদের সাহায্য করার জন্য প্রতিরক্ষা তহবিল করা হয়েছে।’ সে তহবিলে মুক্তহস্তে সাহায্য করার জন্য তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। তবে তার আহ্বানে কেউ যে এগিয়ে আসেননি তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এই দিন বখশীগঞ্জে যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। মুক্ত হয় পীরগঞ্জ, হাতীবান্ধা, পচাগড়, বোদা, ফুলবাড়ী, বীরগঞ্জ ও নবাবগঞ্জ। আর জীবননগর, দর্শনা ও কোটচাঁদপুরে পাক হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে। 

এছাড়া, ১৯৭১ সালের এ দিনে দু’দিক থেকে মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি হানাদাররা। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সর্বপ্রথম স্বাধীন হয় যশোর জেলা। এর আগে ৪ ডিসেম্বর বেনাপোল ও চৌগাছার বয়রা সীমান্ত দিয়ে হামলা শুরু করে মিত্র সেনারা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় সীমান্তবর্তী যশোর জেলা ছিল পাক হানাদারদের অন্যতম প্রধান ঘাঁটি। বীর মুক্তিযোদ্ধারাও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এ জেলাকে স্বাধীন করতে প্রাণপণ লড়াই শুরু করে। ছিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে পাকসেনাদের সঙ্গে তাদের তুমুল যুদ্ধ হয় চৌগাছা ও ঝিকরগাছার জগন্নাথপুর, গরীবপুর, আড়পাড়া, দিঘলসিংহা, ঢেকিপোতা, হুদোপাড়া, কদমতলা, মাশিলা, যাত্রাপুর ও সিংহঝুলি  এলাকায়। 

৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে এ যুদ্ধে যেসব মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। তারা জানায়, জগন্নাথপুর আম বাগান এলাকায় দুই বাহিনীর প্রচণ্ড গোলাগুলির এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের রসদ শেষ হয়। তারপরও থেমে থাকেনি লড়াই। খালি হাতেই এ সময় পাক সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। অস্ত্রের বাট, বেয়নেট, কিল, ঘুসি, লাথি, এমনকি কুস্তাকুস্তি হয় উভয় পক্ষের মধ্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *