চট্টগ্রাম, , শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

কাইছার হামিদ

বিজয়ের গল্প গাথা-৭

প্রকাশ: ২০১৯-১২-০৭ ১১:১৭:১৪ || আপডেট: ২০১৯-১২-০৭ ১১:১৭:২৩

কাইছার হামিদ- ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এদিনে ভুটান স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। দেশের সব স্থান থেকে যখন পরাজয়ের সংবাদ আসতে থাকে তখন যুদ্ধ পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে জেনারেল নিয়াজি গোপন বার্তা পাঠিয়েছিলেন রাওয়ালপিন্ডি হেড- কোয়ার্টার্সে। রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেন, ‘চারটি ট্যাংক রেজিমেন্ট সমর্থিত আট ডিভিশন সৈন্য নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে ভারত। তাদের সাথে আরো আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৬০ থেকে ৭০ হাজার বিদ্রোহী (মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানিরা তখন বিদ্রোহী বলে উল্লেখ করতো)। তিনি আরো লেখেন, স্থানীয় জনগণও আমাদের বিরুদ্ধে।

দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লাকসাম, চাঁদপুর ও যশোর প্রবল চাপের মুখে রয়েছে। পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘ গত নয় মাস ধরে আমাদের সৈন্যরা কার্যকর অপারেশন চালিয়েছে এবং এখন তারা তীব্র যুদ্ধে অবতীর্ণ। গত ১৭ দিনে যেসব খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে, তাতে জনবল ও সম্পদের বিচারে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে গেছে।

রাজাকারদের অস্ত্রসহ শটকে পড়ার সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের নিজেদের ট্যাংক, ভারি কামান ও বিমান সমর্থন না থাকার ফলে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটেছে।’গোপন এ বার্তা পেয়ে হেডকোয়ার্টার থেকে ৭ ডিসেম্বর সম্মুখসমরের সৈন্যদের পিছিয়ে এনে প্রতিরোধ ঘাঁটিতে সমবেত করার জন্য নিয়াজির পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়। তবে অনুমোদনের অপেক্ষায় বসে থাকেনি যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানি সৈন্যরা। ঘাঁটি ছেড়ে তারা ৬ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারেই পালিয়ে যায়। একদল যায় ফরিদপুর-গোয়ালন্দের দিকে। বড় দলটি যায় খুলনার দিকে। ব্রিগেডিয়ার হায়াত তখন ঢাকার দিকে না গিয়ে বস্তুত খুলনার দিকে একরকম পালিয়েই গিয়েছিলেন।
এদিন নিয়াজীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ‘দুর্গ’ যশোরের পতন ঘটে।

ভারতের ৯ম ডিভিশনের প্রথম কলামটি এক রক্তাক্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে যশোর সেনাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়ে দেখতে পায়, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ ভর্তি সুরক্ষিত বাঙ্কার সম্পূর্ণ জনশূন্য। পাকি ‘বীর মুজাহিদ’ চার ব্যাটালিয়ান সৈন্যের এইরূপ অকস্মাৎ অন্তর্ধানে দেশের পশ্চিমাঞ্চল কার্যত মুক্ত হয়। যশোর থেকে ঢাকা অথবা খুলনার দিকে বিক্ষিপ্ত পলায়নপর পাকিরাই অন্যান্য স্থানে স্বপক্ষীয় সৈন্যদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে; দু-তিনটি স্থান বাদে সর্বত্রই পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষার আয়োজনে ধস নামে।

এদিকে মিত্রবাহিনী সিলেটের নিকটবর্তী বিমানবন্দর শালুটিকরে অবতরণ করার পর মুক্তি বাহিনীর সহায়তায় সিলেট শহর মুক্ত করে। ঝিনাইদহ ও মৌলভীবাজারও মুক্ত হয় এদিনে। এদিন যৌথবাহিনী চান্দিনা ও জাফরগঞ্জ অধিকার করে। অবশ্য কুমিল্লা ও লাকসামে তুমুল যুদ্ধ চলছে। বিকালের দিকে বগুড়া-রংপুর সড়কের করতোয়া সেতুর দখল নিয়ে পাকি ও যৌথবাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।

ভারতীয় বেতার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তানী জওয়ান ও অফিসারদের উদ্দেশে শুরু হয় ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ’র মনস্তাত্ত্বিক অভিযান । এদিন রাত ১০টায় আকাশবাণী থেকে হিন্দী, উর্দু ও পশতু ভাষায় জেনারেল মানেকশ বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেন,
তোমাদের বাঁচার কোন পথ নেই। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য তোমাদের ঘিরে রেখেছে। তোমরা যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছ তারা তার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। অনেক দেরি হওয়ার আগেই তোমরা আত্মসমর্পণ কর। তোমাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা ও যুদ্ধাস্ত্রের শক্তি অকেজো হয়ে গেছে, এমনকি বাইরে থেকে বিমানের সাহায্য আসার সম্ভাবনাও নেই। অতএব, তোমরা অস্ত্র ত্যাগ কর। তোমাদের বাঁচার কোন পথ নেই। একমাত্র পথ হচ্ছে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা।

আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকেও বাংলা সংবাদ বুলেটিন প্রচার করা ছাড়াও কয়েক দফায় মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি নিয়ে সংবাদ প্রচার করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও সকাল-সন্ধ্যায় অতিরিক্ত সময়ে যুদ্ধ সমীক্ষ, দেশাত্মবোধক গান ও চরমপত্র প্রচার করে।

এদিকে, যশোরের পতন পাকিস্তানের সামরিক প্রতিষ্ঠানের মূল কেন্দ্রকে নাড়া দেয় প্রবলভাবে। সাত তারিখেই গভর্নর আবদুল মালেক পূর্বাঞ্চলের সৈন্যাধ্যক্ষ লে. জে. নিয়াজীর অভিমত উদ্ধৃত করে এক দুর্গত বার্তায় ইয়াহিয়াকে জানান,
যশোরের বিপর্যয়ের ফলে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের পতন প্রায় সম্পন্ন এবং মেঘনার পূর্বদিকের পতনও কেবল সময়ের প্রশ্ন; এই অবস্থায় ‘আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে যদি প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সামরিক সহায়তা না পৌঁছায়’ তবে জীবন রক্ষার জন্য বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা বাঞ্ছনীয়।

গভর্নর মালেকের এই দুর্গত বার্তা ইসলামাবাদের কর্তৃপক্ষের জন্য আরও বেশী দুর্ভাগ্যজনক ছিল এ কারণে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের দিকে তাদের আকাঙ্ক্ষিত অগ্রাভিযান তখনও কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, একমাত্র ছম্ব এলাকায় কিছু অগ্রগতি ছাড়া। উত্তর-পশ্চিম ভারতের কোন বড় বা মাঝারি ভূখণ্ড দখল করার আগেই পূর্ব বাংলায় তাদের সামরিক নেতৃত্ব যদি আত্মসমর্পণের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে তবে সমূহ বিপর্যয়। কাজেই মালেকের দুর্গত বার্তা ঐ সন্ধ্যাতেই ‘হোয়াইট হাউসে’ পৌঁছানো হয় সম্ভবত অবিলম্বে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য মালেকের আবেদনকে আকুলতর করেই।পাকিস্তান যাতে পূর্বাঞ্চলে পরাজিত না হয় তদমর্মে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পেন্টাগণের সুপারিশ কিসিঞ্জারের কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল ঐ দিনই। ফজল মুকীম খানের বর্ণনা অনুসারে এরও দু’দিন আগে অর্থাৎ ৫ই ডিসেম্বর থেকে নিয়াজীর মনোবল ঠিক রাখার জন্য পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি আবদুল হামিদ আসন্ন চীনা হস্তক্ষেপের সংবাদ নিয়াজীকে দিয়ে চলেছিল।উত্তরের গিরিপথের প্রায় সব ক’টিই তখনও বরফমুক্ত। কিন্তু সিংকিয়াং সীমান্তে সোভিয়েট স্থল ও বিমানবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির তাৎপর্য চীনের জন্য উপক্ষেণীয় ছিল না।

এদিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অর্থনৈতিক সাহায্যদান বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। আর তৎকালীন সোভিয়েট নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ কোন প্রকার বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া পাক-ভারত সংঘর্ষের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানান । নিক্সন প্রশাসনের জন্যেও সমস্যা তখন কম নয়। মার্কিন সিনেটে এবং হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে ডেমোক্র্যাট দলীয় কোন কোন সদস্য পাকিস্তানী জান্তার গণহত্যা, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী নীতির প্রতি মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন এবং জাতিসংঘের বিলম্বিত ও একদেশদর্শী ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। মানবতাবাদী কারণ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরেট জাতীয় স্বার্থের হিসাব-নিকাশ থেকে উপমহাদেশের সংঘর্ষের জন্য ভারতকে এককভাবে দোষী করা, ভারতের উন্নয়ন বরাদ্দ বন্ধ করা প্রভৃতি বিষয়ে মার্কিন সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার যৌক্তিকতা সম্পর্কে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলি নানা প্রশ্ন তোলে। জনমতের এই প্রচণ্ড বিরুদ্ধতা দৃষ্টে ৭ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার নিজেই এক অজ্ঞাতনামা ‘সরকারী মুখপাত্র’ হিসাবে আস্থাভাজন কিছু সাংবাদিকদের কাছে পরিবেশিত এক সমীক্ষার দ্বারা মার্কিন জনমত পরিবর্তনের চেষ্টা করেন।

কিসিঞ্জারের এই বেনামী সমীক্ষা মার্কিন জনমতকে পরদিন কতটুকু বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হত তা অজ্ঞাত থাকলেও, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ উপমহাদেশের যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে সে দিন যে রায় দেন, তা-ই মার্কিন সরকারের পরবর্তী কার্যক্রমের প্রধান মূলধনে পরিণত হয়। সাধারণ পরিষদ ৭ ডিসেম্বর রাত্রিতে (উপমহাদেশে তখন ৮ ডিসেম্বর) অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, উভয় পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহার এবং শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের জন্য রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান সম্বলিত এক প্রস্তাব ১০৪-১১ ভোটে গ্রহণ করে। প্রত্যেক বক্তার জন্য সর্বাধিক দশ মিনিট বরাদ্দ করে উপমহাদেশের এই অত্যন্ত জটিল বিষয়কে অসম্ভব তাড়াহুড়ার মধ্য দিয়ে সাধারণ পরিষদে আলোচনা করার ফলে অধিকাংশ সদস্য দেশের জন্যই বাহ্যত যুক্তিসঙ্গত এই প্রস্তাবের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জন্যই অভ্যন্তরীণ আঞ্চলিক অসন্তোষ এবং বিবদমান প্রতিবেশীর উপস্থিতি এক সাধারণ সমস্যা। ফলে বিপুল ভোটাধিক্যে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। সোভিয়েট ইউনিয়ন, সমাজতন্ত্রী কয়েকটি দেশ, ভারত এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী দ্বিতীয় দেশ ভুটান বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোধ করার জন্য এই আন্তর্জাতিক কূটবুদ্ধির বিজয়ের মুখেও অটল থাকে।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের ভূমিকা সম্পর্কে মুজিবনগর সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে বলেন,

বাংলাদেশের জনগণকে যখন নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছিল তখন জাতিসংঘ নিষ্ক্রিয় ছিল। আক্রমণকারী পাকিসত্মানী সৈন্যদের হটিয়ে বাংলাদেশ যখন সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তখন জাতিসংঘ কর্তৃক যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।

বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। একের পর এক জেলা হচ্ছে হানাদারমুক্ত।এক নদী পেরিয়ে চারদিকে উড়ছে বাংলার পতাকা। বাংলাদেশের বিজয় অনিবার্য । জয় বাংলা !

সূত্র: স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, মূলধারা’৭১, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর,উইইকিপেডিয়া, ইত্তেফাক ও জনকণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *