চট্টগ্রাম, , শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

কাইছার হামিদ

টাকার পাহাড় স্বাস্থ্যের গাড়িচালকের

প্রকাশ: ২০২০-০৯-২১ ০৯:০৪:২৪ || আপডেট: ২০২০-০৯-২১ ০৯:০৪:৩০

দেখলে মনে হয় অত্যন্ত সাদা মানুষ। মাথায় সাদা টুপি। মুখে পাকা লম্বা দাড়ি। ৬৩ বছর বয়সী আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। কর্মচারী হয়ে পাহাড় সমান টাকার মালিক।

তার কাজ কর্মকর্তার গাড়ি চালানো। কিন্তু গাড়ি চালানো তো দূরের কথা খোদ মহাপরিচালকের গাড়ি ব্যবহার করতেন নিজে। ওই গাড়ি চালাতেন অধিদপ্তরের আরেক চালক। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত ওই গাড়িটি কব্জায় ছিল গাড়ি চালক মালেকের।

রোববার অভিযান চালিয়ে কোটিপতি এ গাড়ি চালককে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।
তিনি স্বাস্থ্যে সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদের গাড়ি চালাতেন। প্রভাবশালী এই গাড়ি চালক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ, বদলিসহ নানা অনিয়ম করে শ’ শ’ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। রাজধানীতে গড়েছেন বিলাসবহুল বেশ কয়েকটি বাড়ি। খামার গড়েছেন নিজের নামে। ব্যাংকে জমা করেছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই অবাক হয়েছেন তার সম্পদের তথ্য পেয়ে।

মালেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। দেখতে সাদামাটা ভদ্রবেশী মনে হলেও বাস্তবে তিনি ভয়ঙ্কর এক ব্যক্তি। অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা থেকে শুরু করে আছে জাল টাকার ব্যবসা। অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্য, অর্থ আদায় সবই করেন। গাড়ি চালক পেশার আড়ালে এমন কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড নেই যা তিনি করেন না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের গাড়িসহ আরো তিনটি প্রকল্পের গাড়ি নিজের কব্জায় রেখেছিলেন। অধিদপ্তরের নিয়োগ-বাণিজ্য থেকে শুরু করে ক্রয়, টেন্ডারবাজি ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া অধিদপ্তরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। শুধু তাই নয়, নিজ এলাকায় মালেক ছিলেন মূর্তিমান এক আতঙ্ক। অবৈধ অস্ত্র ও টাকার গরম দেখিয়ে তিনি ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিলেন।

প্রকাশ্য অস্ত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে শক্তির মহড়া দিতেন। তার চক্রে ছিল একাধিক লোক। যাদেরকে নেতৃত্ব দিতেন মালেক নিজেই। তাদের হুমকি-ধমকিতে এলাকার লোকজন তটস্থ থাকতো। ভয়ে কারো মুখ খোলার সাহস ছিল না। কেউ মুখ খুললে তাকে নানাভাবে হয়রানি করতেন। তার ওপর নেমে আসতো খড়গ। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে হয়েছেন টাকার কুমির। বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট- সবই আছে তার। তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন, অবৈধ ব্যবসা, সম্পদ অর্জনের এসব অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই ছিল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতেন।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) প্রাথমিক তদন্ত করে এসব অভিযোগের সত্যতা পেয়ে অবশেষে আব্দুল মালেককে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল ভোরে ঢাকার অদূরে তুরাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তার কাছ থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ৫ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ টাকার জালনোট, ১টি ল্যাপটপ ও ১টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে।

র‌্যাব জানিয়েছে, তাদের কাছে অভিযোগ ছিল তুরাগ এলাকায় আব্দুল মালেক অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, জাল টাকার ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। তার এলাকায় সাধারণ মানুষকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে শক্তির মহড়া ও দাপট প্রদর্শনের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন। এমন অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর অভিযান চালিয়ে তুরাগের কামারপাড়াস্থ বামনের টেক এলাকার ৪২ নম্বর হাজি কমপ্লেক্সে নামের সাততলা ভবনের তৃতীয় তলা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আব্দুল মালেকের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানিয়েছে, মালেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের একজন চালক। ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম সাভার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চালক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে চালক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। বর্তমানে তিনি প্রেষণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত। একজন গাড়ি চালক হলেও অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যাবতীয় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতো মালেক। টাকার বিনিময়ে নিজের পছন্দের লোকদের টেন্ডার পাইয়ে দিতেন। প্রতিটা টেন্ডারেই তিনি ভাগ বসাতেন। অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য সরঞ্জাম থেকে শুরু করে অফিসিয়াল অন্যান্য কেনাকাটায়ও তার দৌরাত্ম্য ছিল। নিয়োগ বাণিজ্যেও একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে চাকরি পাইয়ে দিতেন। দীর্ঘদিন ধরে টেন্ডারবাজি, কেনাকেটা, নিয়োগ-বাণিজ্য করে তিনি কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। তার আধিপত্যের কাছে খোদ অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তি থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পর্যন্ত তটস্থ হয়ে থাকতেন। গাড়ি চালক হয়েও তিনি কোনো গাড়ি চালাতেন না। উল্টো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্ধারিত কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি দিয়ে নিজে চলাফেরা করতেন। সরকারি গাড়ি ভাড়ায় খাটাতেন। অধিদপ্তরের তিনটি প্রকল্পের গাড়ি তার দখলে ছিল। এসব গাড়ি মাসিক ভাড়ায় অন্যত্র খাটাতেন। এই তিনটি গাড়ি ছিল যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার তিনজন প্রকল্প পরিচালকের জন্য বরাদ্দ। অভিযোগ আছে মালেক সব সময় অস্ত্র বহন করতেন। বিষয়টি কর্মস্থলের অনেকেই জানতেন। কাজও হাসিল করতেন অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে। শুধু অধিদপ্তর নয়, তার লম্বা হাত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অভিযোগ আছে মালেকের খুঁটির জোর বেশ শক্ত ছিল।

র‌্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুঘল ছিল আব্দুল মালেক। স্বাস্থ্য সেক্টরে আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, জাল টাকার ব্যবসা করে আসছেন। এর বাইরে অস্ত্রের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তার বিলাসবহুল জীবন ছিল। চলাফিরা করতেন সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সঙ্গে। চালক হিসেবে তার যে আয় সেটি ব্যয় ও সম্পদের সঙ্গে অসামঞ্জস্য ছিল।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, আব্দুল মালেকের স্ত্রীর নামে দক্ষিণ কামারপাড়া এলাকায় দু’টি সাততলা ভবন, বিভিন্ন স্থানে অন্তত ২৪টি ফ্ল্যাট, ১৫ কাঠা জমিতে একটি ডেইরি ফার্ম, হাতিরপুলে সাড়ে চার কাঠা জমিতে ১০ তলা ভবন রয়েছে।

নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে তার রয়েছে কোটি কোটি টাকা।

লাভজনক-অলাভজনক বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। র‌্যাব জানিয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তার আরো বাড়ি, জমি থাকতে পারে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজির প্রাডো গাড়ি গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত তিনি ব্যবহার করেছেন। এছাড়া তিনটি প্রকল্পের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার তিনটি গাড়ি তার দখলে ছিল। অধিদপ্তরের ক্রয়, নিয়োগ-বাণিজ্য টেন্ডার-বাণিজ্য ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। একাধিক বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *