চট্টগ্রাম, , বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

কাইছার হামিদ

ঘুরে এলাম ধ্যানের পাহাড়!

প্রকাশ: ২০২১-০১-১৮ ০১:০৯:১৩ || আপডেট: ২০২১-০১-১৮ ০১:০৯:১৯

কাইছার হামিদ| সন্ধ্যায় ফোন করলাম স্নেহস্পদ বেলালকে। চৌধুরী কোথায়? অপর প্রান্ত থেকে ভাইয়া শহরে! গাড়ীতে উঠো সকালে কোয়ান্টাম যাবো। আমতা আমতা করতে করতে বললো একটু পরে জানাচ্ছি ভাইয়া। জিন্দালাশকে (অধ্যাপক আব্দুল খালেক স্যার) ফোন করলাম। পূর্বকোণের মনির মাষ্টারের অফিসে সাক্ষাত হলো স্যারের সাথে। বেলাল জানালো ভার্সিটির ছোট ভাই জোবাইরসহ আসবে। খালেক স্যারকে তিন জনের যাওয়াটা কনফার্ম করলাম। আমি আবার পূর্ব পরিকল্পনা করে কোন কাজ বা ভ্রমন করতে পারি না। রাতেই বেলাল ও জোবাইর এলো। আমিরাবাদ খাজা হোটেলে খেলাম। তারপর বাসায়। বউ-বাবুরা আজিজ নগরে।

সুবহে সাদিক মাত্র শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই জিন্দালাশের ফোন। পরক্ষণেই জোবাইর হোসেনের ফোন। তিনি লোহাগাড়া কোয়ান্টাম সেন্টারের প্রধান। আয়োজনও ছিল লোহাগাড়া কোয়ান্টাম সেন্টারের। তাড়াহুড়া করে মরিয়ম ভবনের সামনে চলে গেলাম। অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে এসেছে। প্রায় সবাই পরিচিত। শিশু-কিশোর, নারীসহ ৫০/৬০ জনের দল। এ যাত্রাকে কোয়ান্টমের ভাষায় সাফারী বলে। সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম জড়ানো চোখে শুরু হয় চাঁন্দের গাড়িতে করে যাত্রা।

এবড়ো-থেবড়ো পথ পাড়ি দিয়ে ঘণ্টা দেড়েক পরে কোয়ান্টাম পল্লীর সালাম তোরণের সামনে চাঁন্দের গাড়ি থামে। সালামাতানে “সাফারী” লেখা কার্ড গলায় ঝুলিয়ে দেয়। মনোয়ার হোসেন আমাদের টিমের গাইডার। ভদ্রলোক হ্যান্ড মাইকে তাকে অনুসরন করার কথা বলে। তখন আর কারো চোখে ঘুম নেই। ঢুকেইতো অবাক হওয়ার পালা।

অভিবাদন জানাতে দাঁড়িয়ে আছে এক পাল হাতি! সেল্পী তুলতে কেউ মিস করছে না। অসংখ্য ক্লিক। হাতি পালের ডানপাশের ঘর আগে “সালামাতান” ছিল। উঁকি দিয়ে ঘরটা দেখলাম। ঘরের সামনে ডিসপ্লে বোর্ডে “ধ্যানের পাহাড়ে, জ্ঞানের আলো” শিরোনামে আমার একটা লেখা ছিল। এটি আমি ২০০৬ কিংবা ২০০৭ সালে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় লিখেছিলাম। ডিসপ্লে বোর্ডেটিতে বেশ ক’বছর লেখাটি ছিল। এখন নেই। ওই সময় গুরুজীর সাথে প্রথম আলাপ।

হাতমুখ ধুয়ে দরবারান হলে সকালের নাস্তা খেতে বসলাম। এখানে প্রায় তিন শতাধিক লোকের একসাথে খাওয়ার ব্যবস্থা। নাস্তার তালিকায় ছিল রান্না ডিম, পাতলা খিচুরি। পাতলা খিচুড়ী দেখে বেলাল আর জোবাইর আমার দিকে দেখে নাক কুঁচিয়ে হেঁসে দিলো। খাওয়ার পর বুঝলাম কতটা স্বাস্থ্যকর ও স্বাধ। মগটা হাতে নিয়ে দরবারানের বাহিরে রং চা। অনূভূতি ছিল অসাধারণ। পাশে ঝিরি, ফুলগাছ, পাখির কলতানে দাঁড়িয়ে চা’র টান। নিজের বাগান বাড়ীই মনে হলো।

আবার হ্যান্ড মাইকে ঘোষনা মনোয়ার হোসেনের। তাকে অনুসরন করে পথচলা। কান পাততেই শুনলাম-
“সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন, কর্ম ব্যস্ত সুখী জীবন”। হাঁটছি। প্রকৃতির অপরূপ যেমন সৃষ্টি তেমনি নানা কারুকাজ। বেশকিছু স্থাপত্য, কারু শিল্প, অরণ্য, অভয়ারন্য ও সহযাত্রীদের আবেগ-অনুভূতির কথা। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কোয়ান্টামে কাটালেও এই সৌন্দর্য ফুরাবার মতো নয়।

ধ্যান ঘরে উঠলাম। চারদিকে চার রং এর পাথর। যেখানে বসে মানুষ হারিয়ে যায় স্বপ্নের দেশে। এক অনন্য পৃথিবীতে। তারপর অন্য পথ দিয়ে হাঁটা শুরু। সেলিমাতান হয়ে নিচে নামার পালা। সাপ, হরিণ, বানরের স্থাপত্য শিল্প। চোখ জুড়ানো!

অপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্যে আমরা অভিভূত। স্রষ্টার এক অপূর্ব সৃষ্টি- চোখে না দেখলে, অনুভব করার সুযোগ না পেলে, যা কল্পনা করাও অসম্ভব। সেখান থেকে ফিরে শেফায়াতান ও মসজিদ দেখে এলাম।

আবার সালামাতান সংলগ্ন হলে কোয়ান্টামম এর উপর নির্মিত ডকুমেন্টারি দেখলাম। কোয়ান্টাম শুধু ধ্যানের জগত নয়। এখানে প্রতিটি শিশু বেড়ে উঠছে নিবিড় তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে শুরু করে খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা, শারীরিক প্রশিক্ষণ, ব্যায়াম, মেডিটেশন, নৈতিক মানবিক ও আত্মিক শিক্ষা সবকিছুতেই দীক্ষিত করা হচ্ছে এদের। শিক্ষা ও সুযোগ পেলে যেকোনো মানুষই যে তার মেধাকে বিকশিত করতে পারে তার প্রতিভার স্বীকৃতিকে আদায় করে নিতে তারই এক উজ্জ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানকার শিক্ষার্থীরা। অথচ এখানকার প্রতিটি শিশু সুবিধাবঞ্চিত ছিলো।

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী হতে শুরু করে সর্বত্রই এদের জয়জয়াকার অবস্থা। জাতীয় বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত কুচকাওয়াজে অংশ গ্রহন করে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। জাতীয় স্কুল খো খো প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশ নিয়েই চ্যাম্পিয়ন। অনুর্ধ ১৬ বিশ্ব যুব অলিম্পিক গেমস এর আরচ্যারি’ ইভেন্টে সাফল্য, ৮ম বাংলাদেশ গেমসে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জপদক অর্জন, জাতীয় বয়সভিত্তিক জিমন্যাস্টিকসে স্বর্ণপদক জয়, হ্যান্ডবলে প্রথম বিভাগে উন্নীত। ডকুমেন্টারীতে এমন দাঁড়িয়েছে যে ‘কোয়ান্টা’ মানেই প্রথম।

ভাবলাম, একটা সময় পার্বত্য এই শিশুরা কৈশোরোত্তীর্ণ হতে না হতেই বলি হতো তথাকথিত শান্তি বাহিনীর হাতে। সেই শিশুরা আজ মেধা-মননসহ সব দিকে ছাপিয়ে উঠেছে। যেন একখন্ড স্বপ্নের বাংলাদেশ! একটি অবহেলিত জনপদে কী বিস্ময়কর বাঁক বদলের সূচনা হয়েছে! যে অনাথ অসহায় শিশুরা একসময় শিক্ষার আলো বঞ্চিত ছিল, ছিল সকল ধরনের সুযোগ সুবিধার বাইরে, তারাই আজ প্যারেড ও ডিসপ্লের লাগাতার চ্যাম্পিয়ন। ‘হবেই হবে, হবে নিশ্চয়, শাশ্বত সত্যের হবেই জয়’। ডকুমেন্টারীর শিরোনাম ছিল “আমরা পারি”।

১২:৪৫। হাতমুখ ধুয়ে পাশের দরবারানে ঢুকে দেখলাম শত শত জন ডাইনিং টেবিলে বসে সুশৃঙ্খলভাবে খাচ্ছে। কোয়ান্টামের কর্মচারীরা তাদের সামনে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। সু-স্বাধু খাবার। নামাজ। একটু বিশ্রামের জন্য জোবাইর হোসেন দেখিয়ে দিলেন দরবারানের পাশে একটি লম্বা ঘর। গণবিছানার ব্যবস্থা দেখে চমকে উঠলাম আমরা। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক গণবিছানা।

আবার পথ চলা। ধরিয়ে দিলো লাঠি। পথে যেতে যেতে বিভিন্ন পাহাড়ে কোয়ান্টামের বনায়ন দেখার সুযোগ হলো। ব্যাম্বোরিয়ামে এসে মুগ্ধতা ভাষা কেড়ে নিল। প্রকৃতির সাথে একাত্নতার এ এক অপার্থিব অনুভূতি। সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর হলো বাঁশের পাতার সৌন্দর্য। সবুজের সতেজতা আর পাতায় পাতায় রৌদ্র-ছায়ার খেলা। বড় অবাক করার বিষয় ত্রিশ প্রকার বাঁশ! প্রকৃতির সাথে এত বেশি সাযুজ্যপূর্ণ যে হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে এটা যেন নিবিড় প্রকৃতিরই একটা অংশ।

জিমন্যাসিয়াম দেখলাম। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। অলম্পিক জয়! এগিয়ে যাওয়ার আরেক সোপন। পথে পথে বনায়ন। সৌন্দর্য্য, অপূর্ব, পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ। আহ কত শান্তি! কত সুখ! পৌঁছে গেলাম আরোগ্যশালা। এটিই হয়তো সমুদ্রতল দেশ হতে সর্বোচ্চ চূড়া। চারদিকে চার রং এর পাথর। শুরু হয়ে গেলো ধ্যান। শরীরের সুস্থতা অনূভব। কিছু আদর, কিছু ভালবাসা, কিছু আবেগ, কিছু ভাবনা, কিছু স্বপ্ন, কিছু প্রার্থনা, স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া। শেষ হলো ধ্যান। ফিরে এলাম পৃথিবীতে। হয়ে গেলাম এক অনন্য মানুষ।

ফিরে যাবার পালা। এলাম দরবারানে। খেলাম বিকেলের নাস্তা। এক মগ লাল চা নিয়ে পাখির কলতানে দাঁড়িয়ে চা খেলুম। এখানকার প্রত্যেকটা সদস্য মিষ্টিভাষী ও সু-শৃংখল। বেরিয়ে পড়লাম। সালামাতানের পাশে টিং টিংওয়ান। বিস্কুট, কেক, পাউরুটি ও হস্তশিল্পের কিছু শৈল্পিকতার চিহৃ নিলাম। চাঁন্দের গাড়ীতে ওঠে মজার মজার অভিজ্ঞতার বর্ণনায় ভেসে গেলাম। পৌঁছে গেলাম বাসার সামনে ফোরকান টাওয়ারে।এক দিনের সফরের নিখুঁত বর্ণনা এত ছোট্ট পরিসরে দেয়া কোনভাবেই সম্ভব না।ফলশ্রুতিতে বাদ পড়েছে বেশকিছু।লিখতে পারিনি সহযাত্রীদের আবেগ-অনুভূতির কথা। জিন্দালাশ জানালো ২০ ভাগের ১ ভাগও দেখা হয়নি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কোয়ান্টামে কাটালেও এই সৌন্দর্য ফুরাবার মতো নয়। আবার আসতে হবে, বার বার আসতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *