চট্টগ্রাম, , বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

admin

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত তিন জেলায় আবারো সেনা অভিযান : ঘরছাড়া ১০ হাজার নারী-পুরুষ

প্রকাশ: ২০১৭-০৮-১৮ ০৫:৫৮:০০ || আপডেট: ২০১৭-০৮-১৮ ০৫:৫৮:০০

ডেস্ক রিপোর্ট: 

মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত তিনটি বৃহৎ এলাকায় সে দেশের সৈন্যরা অভিযান শুরু করেছে। তাদের বেপরোয়া মারধর ও গুলিবর্ষণে মিয়ানমারের সীমান্ত জেলা মংডু, বুথিদং ও রাথিদং শহরে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। প্রাণভয়ে পালাতে শুরু করেছেন রোহিঙ্গা মুসলিমরা। মিয়ানমার সেনাদের নির্মম নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। ইতোমধ্যে ঘরছাড়া হয়েছে নির্যাতনের শিকার তিন জেলার অন্তত ১০ হাজার মানুষ।

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, কথিত মুসলিম বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাকামীদের নির্মূল করতে সার্জিক্যাল অপারেশনের নামে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেনা মোতায়েন করায় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ইয়াঙ্গুন থেকে আকাশপথে আরাকানের আকিয়াব অবতরণ করে সেনারা। সেখান থেকে বিভক্ত হয়ে সড়ক ও নৌপথে মংডু, বুথিদং ও রাথিদংয়ে গিয়ে পৌঁছে।

প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। এতে করে আরাকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভয়ভীতি দেখা দিয়েছে। এ অভিযানে গত এক সপ্তাহে দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে বলে জানান রোহিঙ্গারা। রাখাইনের অভিযান থেকে বাঁচতে আবার শত শত রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রায় প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ সীমান্তে জড়ো হয়েছেন। এ কারণে রোহিঙ্গাদের প্রবেশের আশঙ্কায় বাংলাদেশ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

এ দিকে গত মঙ্গলবার রাথিদং এলাকার আটজন নিরীহ রোহিঙ্গাকে বেধড়ক প্রহার করে গুরুতর আহত করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। বেদড়ক প্রহার ও অস্ত্রের আঘাতে তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ থেতলে দিয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, রাথিদংয়ের ফিরিন্দক রোহিঙ্গা পল্লীতে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় কয়েক প্লাটুন সেনাসদস্য গিয়ে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে তল্লাশি চালায়। এ সময় তারা ঘরের দামি জিনিসপত্র, স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা ও মোবাইল সেট লুট করে।

পরে অবৈধ কোনো কিছু না পাওয়ায় পুরুষদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে বেধড়ক প্রহার করে সেনা সদস্যরা। বন্দুকের নল দিয়ে খোঁচা মেরে মেরে রক্ত বের করে। মাথা, মুখ, কোমরসহ স্পর্শকাতর অঙ্গে আঘাতের পর আঘাত করে। জুতার গোড়ালি দিয়ে আঘাত করে থেতলে দেয় শরীরের বিভিন্ন অংশ। সামরিক বাহিনীর বেধড়ক প্রহারে গুরুতর আহতদের চিকিৎসার জন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারেনি পরিবারের সদস্যরা। গ্রাম থেকে বাইরে যেতে রোহিঙ্গাদের নিষেধ করেছে সেনা কর্তৃপক্ষ। এতে আহতদের শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হচ্ছে।

এ দিকে গত মঙ্গলবার বুথিদং জেলার ওলাফে ইউনিয়নের ওলাফে রোয়াগ্রী, টংরোয়া ও কেওয়া রোয়াসহ কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রামে তাণ্ডব চালিয়েছে সেনাবাহিনী, লুন্টিং ও বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিবি)। ভোর ৪টা থেকে কয়েকটি গ্রাম ঘেরাও করে নিরীহ রোহিঙ্গাকে গণগ্রেফতার করে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গাকে নিয়ে গেছে সামরিক বাহিনী। রোহিঙ্গারা যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন গ্রাম ঘেরাও করে সামরিক বাহিনী। তার পর চিরুনি অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা পুরুষদের যাকে যেখানে পেয়েছে সেখান থেকে আটক করেছে। তাদেরকে রশি দিয়ে বেঁধে প্রথমে স্কুলে তালাবদ্ধ করে রাখলেও পরে মারতে মারতে ইয়ংশং ক্যাম্পে নিয়ে গেছে।

সূত্র আরো জানিয়েছে, সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে তল্লাশি করার সময় টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল সেটসহ দামি জিনিসপত্র লুট করে নেয়।

এ দিকে ওই সব গ্রামে চলছে এখন নারী ও শিশুদের আহাজারি।
গতকাল সোমবার রাথিদং জেলার চৌপ্রাং এলাকার বড়বিলে হামলা চালিয়েছে সরকারি বাহিনী। লুন্টিং ও সেনার সম্মিলিত বাহিনীর কয়েক প্লাটুন সদস্য বড়বিলে আক্রমণ করে এ তাণ্ডব চালায়। বড়বিল গ্রামে অভিযানের নাম করে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে তল্লাশি চালায় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় রোহিঙ্গাদের মারধর, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, দোকান লুটপাট, আটক, নারীদের শ্লীলতাহানি ও দামি জিনিসপত্র লুট করে নেয় তারা। সূত্র জানিয়েছে, সেনাদের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন আট রোহিঙ্গা। তিনজন হতদরিদ্র রোহিঙ্গার বসতবাড়ি ভেঙে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৯টি রোহিঙ্গা বাড়ির বৈদ্যুতিক সোলার ও ৪টি দোকানের সর্বস্ব লুট করে নিয়েছে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা।

বেশ ক’জন রোহিঙ্গাকে আটকও করেছে তারা। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুরুল হাসান খান জানান আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে সে দেশের সরকারকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এ জন্য আমরা আমাদের সীমান্তে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সতর্ক রয়েছি।

টেকনাফে ২ নং বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম জানান, নাফ নদীর ওপারে আরাকানে সেনা মোতায়েনের খবরে আমরা বিচলিত নই। কারণ সেটি মিয়ানমার সরকারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তার পরও সীমান্তের কাছাকাছি এভাবে সেনা সমাবেশ বাড়ানোর ঘটনায় আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছি। বাংলাদেশের মিয়ানমার সীমান্তের স্থল ও নৌপথগুলোয় বিজিবিকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। নাফ নদীর অপর প্রান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সমাবেশ বাড়ানোর খবরে সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বছরের অক্টোবরে আরাকানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাবিরোধী কয়েক মাসের কঠোর অভিযান চালায়। সেনাবাহিনীর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে অন্তত ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। সেই সময় আরাকানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ধর্ষণ, হত্যা ও রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে।

আরাকানে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বসবাস করে আসছেন কয়েক প্রজন্ম ধরে। এসব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সে দেশের নাগরিকত্ব দেয়নি। উপেক্ষিত হচ্ছে তাদের মৌলিক মানবিক অধিকারের বিষয়ও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *