চট্টগ্রাম, , শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

admin

কুরবানির তাৎপর্য ও মাসায়িল : হাফেজ মৌলানা ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব জালাল

প্রকাশ: ২০১৭-০৮-২৬ ১৫:২১:৪২ || আপডেট: ২০১৭-০৮-২৬ ১৫:২১:৪২

শাব্দিক বিশ্লেষণ:
কুরবান শব্দটি আরবী, কুরবুন মূল ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ নৈকট্য অর্জন করা, সান্নিধ্য লাভ করা, উৎসর্গ করা ইত্যাদী। পারিভাষিক অর্থে কুরবানি ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহ’র নৈকট্য অর্জিত হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়িদার ২৭ নং আয়াতে হযরত আদম (আ) এর সন্তান হাবিল আর কাবিলের ত্যাগের মাধ্যমে নৈকট্য অর্জনের বিষয় বর্ণনা করতে গিয়ে উক্ত শব্দটি উল্লেখ করেছেন। কুরআন ও হাদীস পর্যালোচনা করলে দেখায় যায় যে, কুরবানির জন্য আরও বহু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তা হল নাহার (উট কুরবানি) ও উজহিয়্যা, নুসুক (গরু, ছাগল কুরবানি)। নাহার শব্দ সূরা কাউসারের ২ নং আয়াত এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন- তোমার রবের জন্য সালাত পড় আর নাহার (কুরবানি) কর। নুসুক শব্দটি সূরা আনআমের ১৬২নং আয়াতে এসেছে। আল্লহ তাআলা বলেন- বলুন, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার নুসুক, আমার জীবন ও মরণ ঐ আল্লহ’র জন্য, যিনি বিশ্ব জাহানের রব। উযহিয়্যা ও নুসুক শব্দদ্বয় সহীহ বুখারীর ৯৫৫নং হাদীসে এসেছে। বারা বিন আযিব (রা) বলেন, রাসূল (স) ঈদুল আযহার দিন সালাতের (ঈদুল আযহার) পর খোৎবায় বলেছেন- যে আমাদের সাথে সালাত (ঈদুল আযহার) পড়েছে, আমাদের সাথে নুসুক করেছে, তার নুসুক হয়েছে। আর যে সালাতের আগে কুরবানি করে তার নুসুক হয়নি। সূরা ছাফ্ফাতের ১০২ নং আয়াতে বর্ণিত ইব্রাহীম (আ) কর্তৃক ইসমাঈল (আ) কে (যবেহ) কুরবানি দেওয়ার ঘটনার মাধ্যমে কুরবানির রূপ পরিবর্তন হয়। পুড়ে দেওয়ার বিধান রহিত করে খাওয়ার বিধান প্রবর্তন হয়। ঐদিনটি আল্লাহ’র বড়ত্ব ও মহত্ত্ব বর্ণনার করার দিন- সূরা সূরা বাকারা ১৮৫।

কুরবানির সূচনা ও তাৎপর্য্য:
কুরবানি চলে আসছে আদম (আ) যুগ থেকে। আল্লাহ তাআলা বলেন- আর আমি প্রত্যেক জাতির জন্য কুরবানির বিধান দিয়েছি, যেন তারা গবাদিপশু থেকে যে রিযিক তাদেরকে দিয়েছেন তার জন্য আল্লাহ’র নাম স্মরণ করতে পারে। মূলত তোমাদের ইলাহ একক, সুতরাং তার জন্যই তোমরা আত্মসমর্পন কর, আর বিনয়ন¤্রদেরকে সু সংবাদ দাও- সূরা হাজ্জ ৩৪। কেউ কুরবানির মাধ্যমে নিজেদের বড়ত্ব প্রকাশ বা গোশত খাওয়ার মনোভাব থাকলে জঘন্য পাপ হবে- সূরা মাঊন ৬। মুয়াত্তা মালেক এর ১০৪০ নং হাদীসে হযরত আবু আইয়ুব আনছারী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নিজের ও পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল দিয়ে কুরবানি করতাম। অতঃপর মানুষ বড়ত্ব প্রদর্শরের জন্য জনপ্রতি করছে। এর মানে এই নয় যে, কেউ ছাগল ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে কুরবানি করলে হবেনা, বরং উক্ত হাদীসটিতে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি ও একনিষ্ঠতার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। অর্থাৎ যাই করুক, আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। লোক দেখানোর মনোভাব পরিহার করতে হবে। অতএব আল্লাহ’র বড়ত্ব ঘোষণা করাই ঐদিনের তাৎপর্য। অভাবী মানুষের মাঝে গোশত খাওয়ার ব্যবস্থা করাই তাৎপর্য। আল্লাহ’র নেয়ামতের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁকে স্মরণ করাই তাৎপয।

যিলহাজ্জ মাসের ১ম দশ দশকের ফজীলত:
‘যিলহাজ্জ মাসের ১ম দশকের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় কোন আমল আল্লাহ’র নিকট অন্য কোন (নফল) আমল নেই। ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে রাসূল! আল্লাহ’র রাস্তায় জিহাদও নয়? রাসূল (স) বললেন, জিহাদও নয়। তবে ঐ ব্যক্তির (আমলের সমান নয়), যে নিজের জান ও মাল নিয়ে বেরিয়েছে, আর ফিরে আসেনি (অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে)- মিশকাত হা/১৪৬০ ‘ছালাত’ অধ্যায় ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ। ঐ দশকে রয়েছে ইয়াওমুল আরাফার দিন, যে দিন সিয়াম (রোযা) পালন করলে আগের এক বছর ও পরের এক বছরের গোনাহ আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করে দেন- মিশকাত হা/২০৪৪ ‘ছওম’ অধ্যায়, ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ। অতএব কেউ ইচ্ছা করলে উক্ত দশ দশককে গুরুত্ব দিতে পারে।

কুরবানির ফজীলত:
কুরবানির ফজীলতের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায়না। সর্বাধিক পরিচিত ও আলোচিত যে হাদীসটি পাওয়া যায়, তা হল- কুরবানির দিন আল্লাহ’র নিকট রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে অধিক প্রিয় আর কিছু নেই। ঐ ব্যক্তি কিয়ামতের দিন তার (পশুর) শিং, লোম ও ক্ষুরসমূহ নিয়ে হাজির হবে। আর কুরবানির রক্ত যমীনে পতিত হওয়ার আগেই আল্লাহ’র নিকট মার্যাদার স্থানে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা তার মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ কর- সুনান তিরমিজী কুরবানির মর্যাদা অধ্যায় ১৪৯৩।

কুরবানির উদ্দেশ্য:
কুরবানির উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া তথা আল্লাহভীরুতার পরীক্ষা দেওয়া। হাবিল ও কাবিলের বিষয়ে বর্ণিত আয়াতেও উক্ত বিষয় ফুঠে উঠেছে। হাবিল বলেছিল যে, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকী তথা আল্লাহভীরুদের পক্ষ থেকেই (কুরবানি) কবুল করেন- সূরা মায়িদা ২৭। পবিত্র কুরআনে আরও বর্ণিত আছে যে- আল্লাহ তার গোশ্ত, রক্ত চাননা। বরং চান তোমাদের তাকওয়া (আল্লাহ ভীরুতা)- সূরা হাজ্জ ৩৭। আর সেই তাকওয়ার আত্মা ও মালের পরীক্ষার একটি হল কুরবানি- সূরা হাজ্জ ৩২।

কুরবানি কবুলের শর্ত:
১. ঈমান বিশুদ্ধ থাকা। শিরক ও কুফরীযুক্ত ঈমান দিয়ে ইবাদাত কবুল হয়না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা বলেন- আর যে সকল মু’মিন নর নারী সৎকাজ করে, তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে, তিলপরিমাণও অন্যায় করা হবেনা- সূরা নিসা ১২৪, মুসনাদে আহমদ ২০০৩৭ হাসান।
২. ইখলাছ অর্থাৎ বিশুদ্ধ নিয়ত তথা একনিষ্ঠতা। একনিষ্ঠতা ছাড়া ইবাদাত কবুল হয়না। ইবাদাতের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আল্লাহ’র সন্তুষ্টি হতে হবে। সূরা মাঊনের ৬নং আয়াত অনুযায়ী অনেক নামাযী ব্যক্তির জন্যই দুর্ভোগ থাকবে শুধুমাত্র লোক দেখানো সালাত আদায় করার কারণে। একনিষ্ঠতা না রেখে লোক দেখানো উদ্দেশ্য হলে অনেক সময় সেটি শিরকে পরিণত হয়। যাকে শিরকে খফী বলে। রাসূল (স) বলেছেন- আমার উম্মতের জন্য দাজ্জালের চেয়ে যার বেশি ভয় করছি, তার ব্যাপারে কি আমি জানাবনা? তিনি বললেন, গোপনীয় শিরক- সুনান ইবনে মাজাহ রিয়া অধ্যায় ৪২০৪ হাসান। অতএব বিশুদ্ধ নিয়তই তাকওয়ার পরিমাপক। মহান আল্লাহ বলেন- বল হে নবী, আল্লাহ’র জন্য একনিষ্ঠ ইবাদাতের জন্য আমি আদিষ্ঠ হয়েছি- সূরা যুমর ১১।
৩. সালাত কায়েম করা। মহান আল্লাহ নাহার ও সালাত সূরা কাউসারের একই আয়াতে উল্লেখ করে এটিই বুঝিয়েছেন যে, কুরবানি কবুলের পূর্বশর্ত হচ্ছে সালাত (নামায)। সুতরাং কেউ কুরবানি কবুল করার ইচ্ছা করলে তার উচিত হল পূর্বের সালাত ত্যাগের জন্য তাওবা করা, আর ভবিষ্যতে সালাত আদায় করার প্রতিজ্ঞা করা। অন্যথায় কুরবানি হবে কি হবেনা আল্লাহই ভাল জানেন।
৪. হালাল তথা বৈধ মাল দিয়ে কুরবানি করা। হালাল মাল ছাড়া জাকাত, সদকা, কুরবানি ইত্যাদী কবুল হয়না। রাসূল (স) বলেছেন- আল্লাহ তাআলা ভাল (পবিত্র) ছাড়া কবুল করেননা- সহীহ বুখারী ১৪১০। তিনি আরও বলেছেন- আল্লাহ বলেন, — তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোষাক হারাম, সে যা গ্রহণ করেছে তা হারাম, কিভাবে দুয়া কবুল করা যায়- সহীহ মুসলিম সদকা কবুল অধ্যায় ১০১৫।
৫. রাসূল (স) এর সুন্নাত অনুযায়ী কুরবানি করা। ইবাদাত কবুলের অন্যতম আরেকটি শর্ত বিদাত পরিহার করে সুন্নাহ অনুযায়ী কাজটি সম্পাদন করা। অর্থাৎ রাসূল (স) কাজটি যেভাবে যেখানে যখন করেছেন, সেভাবে সেখানে সে সময় সম্পাদিত করার যথাযত চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন- কোন মু’মিন নর নারীর জন্য এটি বৈধ নয় যে, যেটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ফায়সালা করে দিয়েছেন, তাদের কর্মের জন্য অন্য একটিকে উত্তম হিসেবে নির্বাচন করা। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্ট হবে- সূরা আহযাব ৩৬। তিনি আও বলেছেন- তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহ’র রাসূলের জীবনে উত্তম আদর্শ- সূরা আহযাব ২১। সাহাবায়ে কেরাম (রা)গণ রাসূল (স) এর পথ থেকে সামান্য বিচ্যুতি হলেই সাবধান করতেন- সুনান আততিরমিজী সফরে বিতর অধ্যায় ৪৭২ সহীহ। অন্য দিকে বিদাতী ব্যক্তির ফরজ ও নফল কোন প্রকার ইবাদাত কবুল হবেনা- সুনান নাসায়ী ৪৭৮৯।

কুরবানির হকুম:
কুরবানি ফরজ না ওয়াজিব নাকি সুন্নাত, এই ব্যাপারে বিশ্বের বরেণ্য আলেম উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ ওয়াজিব বলেছেন আবার কেউ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলেছেন। শুধু হানাফী মাজহাবেই দুইটি মত রয়েছেন- (ক) ইমাম আবু হানিফা (র) ও তার সাথীগণ স্বচ্ছল স্থায়ী (মুসাফির নয়) ব্যক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব বলেছেন, অন্যদিকে তাঁরই শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ (র) বলেছেন সুন্নাত, ছেড়ে দিলে পাপ হবেনা- আন নুতফ ফিল ফাতওয়া পৃ ২৩৯/১। তবে রাসূল (স) এর হাদীসে কুরবানির ব্যাপারে কঠোরতা রয়েছে। তিনি বলেছেন- সম্পদের মালিক হলে কুরবানি করবে, নতুবা সে যেন আমাদের ঈদগাতে না যায়- মুসতাদরাকে হাকীম ৭৫৬৫সহীহ। বিশ্ববিখ্যাত মুফতি ও মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ বিন বায (র) বলেছেন, কুরবানি ওয়াজিব নয় বরং প্রত্যেক স্বচ্ছল ব্যক্তির উপর সুন্নাত- মাজমু ফাতওয়া বিন বায ৩৬/১৮। আরেক বরেণ্য আলেম শেখ উছাইমিন (র) বলেছেন, স্বচ্ছল ব্যক্তির জন্য উচিত নয় যে, কুরবানি ছেড়ে দেওয়া- ফাতওয়া ওয়া রাসাইল ২২/২৫। অন্য দিকে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, কুরবানি ওয়াজিব- মাওকাউল ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব ২৭/১৩। সকল মত একত্রি করলে এটিই প্রতিয়মান হয় যে, স্বচ্ছল ব্যক্তির জন্য কুরবানি করা অবশ্যই কর্তব্য। সুন্নাত হউক বা ওয়াজিব হউক, যেহেতু রাসূল (স) হাদীসকে গুরুত্ব দিয়ে ও অন্তরে তাঁর ভালবাসা নিয়ে আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করা উচিত।

কি দিয়ে কুরবানি করা সুন্নাত:
গরু, ভেড়া, উট ও ছাগল বা দুম্বা – সুনান ইবনে মাজাহ ৩১৩৯ সুনান আবু দাউদ ২৭৯৩ সহীহ। এই ছাড়াও চতুষ্পদ যেকোন হালাল প্রাণী দিয়ে করা যেতে পারে। উত্তম হল উট, গরু ও ছাগল দিয়ে করা। তবে উচিত হল, ঐ সব প্রাণী পেলে অন্য প্রণী দিয়ে না করা। আবার করলে হবেনা তা নয়। উত্তমটি করাই শ্রেয়।

কুরবানির পশুর বয়স:
উট হলে ৫বছর, গরু ২বছর, ছাগল হলে ১বছর ভেড়া বা দুম্বা ৬মাস বয়সী হতে হবে- ফাতওয়া লাজনা দাইমা ১১/৩৭৭, আল মুগনী ১৩/৩৬৮।
যে সব পশু দিয়ে কুরবানি হবেনা:
পশু স্পষ্ট রোগা, অন্ধ, অতিদুর্বল ও ন্যাংড়া না হতে হবে- সুনান আবু দাউদ ২৮০২ সহীহ। তবে রাসূল (স) কান ও শিং নষ্ট পশুও অপছন্দ করতেন বলে বিশুদ্ধ হাদীস সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু নিষেধ করেননি- সুনান নাসায়ী ৪৩৭০। রাসূল (স) এর অপছন্দই আমাদের জন্য অপছন্দ হওয়া উচিত।

ভাগে কুরবানি:
গরু ও উট ৭ জনের পক্ষ থেকে বৈধ- মুসনাদে আহমদ ১৩২৪৭ সহীহ। তবে রাসূল (স) ও সাহাবী (রা)গণ সফর ছাড়া অন্যাবস্থায় ভাগে কুরবানি করেছেন বলে সুস্পষ্ট কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায়না। তবে সৌদি ফাতওয়া বোর্ড উট ও গরুতে সর্বাবস্থায় ৭ জনের অংশিদারিত্বে কুরবানি বৈধ বলে ফাতওয়া দিয়েছেন- ফাতওয়া লাজনা ১১/৪০১। যেহেতু হাদীস অনুযায়ী মুসাফির অবস্থা ছাড়া মুকিম (স্থায়ী বাসিন্দা) অবস্থায় ভাগের আমলটি পাওয়া যায়না, সেহেতু একা করাই উত্তম। ইদানিং সমাজে একটি অপসংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে যে, বহু মানুষ ৫০০/১০০০/২০০ইত্যাদী টাকা দিয়ে একটি গরু কিনে কুরবানের দিন যবেহ করে ভাগ ভাটোয়ারা করে খাচ্ছে! আমার মতে এটি আল্লাহ’র হকুম ও রাসূল (স) এর সুন্নাতের সাথে তামাশার শামিল। মুসলমানদের এসব পরিহার করা উচিত। কারণ; কুরবানির উদ্দেশ্য গোশত খাওয়া নয়।

আনুষাঙ্গিক অন্যান্য মাসায়িল:
১. কেউ কুরবানি করার ইচ্ছা করলে সে যেন, জিলহজ্জ মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার পর থেকে কুরবানির আগপর্যন্ত নখ, লোম ও চুল ইত্যাদী না কাটে- সহীহ মুসলিম ৫২৩২। কাটলে কুরবানি হবেনা এমন নয়।
২. কেউ নামাযের আগে কুরবানি করে নিলে তাকে অবশ্যই আবার কুরবানি করতে হবে- সহীহ বুখারী ৯৮৩, ৫৫০০।
৩. কেউ চাইলে নিজ স্ত্রীর পক্ষ থেকে তার অনুমতি ছাড়া কুরবানি দিতে পারে- সহীহ বুখারী ২৯৫২ সহীহ মুসলিম ১৩১৯।
৪. কেউ চাইলে পুরা পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মাত্র পশু কুরবানি দিতে পারে- সুনান আবু দাউদ ১৭৫০ সহীহ।
৫. কুরবানির পশুর গোশত সম্পূর্ণ বন্টন করে দিলে কোন অসুবিধা নেই- সহীহ বুখারী ৫৫৪৭। তবে কেউ চাইলে ইচ্ছামত এবং যে কোন দিনের জন্য রাখতে পারে- সহীহ বুখারী ৫২৪৭।
৬. বিশুদ্ধ হাদীস সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূল (স) আকীকা করার আদেশ দিয়েছেন, ছেলের পক্ষ থেকে দুইটি ও মেয়ের পক্ষ থেকে একটি ছাগল করতে- সুনান আবু দাউদ ২৮৩৬। বরং তার জন্য আলাদা প্রাণ দেওয়া বাধ্যতামূলক- সহীহ বুখারী ৫০৭৬। রাসূল (স), সাহাবায়ে কেরাম (রা)গণ, ইমাম (র)গণসহ কেউ কুরবানি ও আকীকা একই পশুতে করেছেন মর্মে কোন বর্ণনা পাওয়া যায়না। আকীকা শিশু জন্মের সাত দিনের মধ্যে, আর কুরবানি যিলহাজ্জ মাসের ১০ম দিনে। দুইটি আলাদা আমল।
৭. মৃত ব্যক্তির জন্য কুরবানির স্পষ্ট কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায়না, বরং তাদের জন্য দান করাই উত্তম। যদি করে, তাহলে সম্পূর্ণ গোশত বন্টন করে দিতে হবে বলে বিজ্ঞ আলেমগণ মত দিয়েছেন- সরহুস্সুন্নাহ লিল বাগাবী ৩৫৮/৪। রাসূল (স) এর হাদীস অনুযায়ী সকল মুসলমান বলতে জীতি ও মৃত সবাই বুঝায়। তবে শেখ উছায়মিন ও বিন বায (র) তাদের জন্য কুরবানির মূল্য দান করে দেওয়াকে উত্তম বলেছেন- ফাতওয়া বিন বায ১৮/৪০, ফাতওয়া ও রাসাইল ১৭/২৪৪।
৮. পশুর আবরণ ও চামড়া সদকা করে দিতে হবে, কুরবানির পশুর গোশত কিংবা অন্য কোন কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া নিষেধ- সহীহ বুখারী ১৬০৮, ৫১৫৪।
৯. আমাদের অনেকে পশুর প্রথম বাচ্চা কুরবানি দেওয়ার জন্য মানত করে থাকে, প্রথম বাচ্চা কুরবানিতে অতিরিক্ত কোন ছওয়াব নেই- সহীহ বুখারী বুখারী ৫০৭৮ মুসলিম ৪৯৬০। বরং এটি জাহেলী মতবাদ।

পশু যবেহ করার সুন্নাতী পদ্ধতি:
১. নিজ হাতে কুরবানি দেওয়া- সহীহ বুখারী ১৬০৪
২. ঈদগাতে যবেহ করা- সহীহ বুখারী ৫১৫৪
৩. যবেহ করার পূর্বে তাকবীর ও বিসমিল্লাহ বলে আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল (হে আল্লাহ কবুল কর) বলে কুরবানি দাতার নাম উল্লেখ করা- মুসনাদে আহমদ ২৪৪৯১ সহীহ, সহীহ বুখারী ৫১৬৬।

কুরবানির দিনের অন্যান্য আমল:
১. কুরবানির ঈদের সালাতের আগে কুরবানি দাতা কিছু না খাওয়া- সুনান ইবনে মাজাহ ১৭৫৬ সহীহ।
২. ঈদগাহে যাওয়ার আগে গোসল করা- মুওয়াত্তা মালেক ৬০৯ হাদীসটি মাওকুফ তথা সাহাবীর আমল।
৩. উত্তম পোষাক পরিধান করা- সহীহ ইবনে খুজায়মা ১৭৬৬ হাদীস যঈফ, তবে নাসায়ীর ১৫৬০ নং হাদীসে সহীহ সূত্রে ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে।
৪. ঈদগাহে যাতায়াত রাস্তা পরিবর্তন করা- সহীহ বুখারী ৯৮৬।
৭. খুতবা শোনা- সুনানে ইবনে মাজাহ ১২৯০ হাদীসটি সহীহ।
৮. তাকবীর বলা- সূরা বাকারা ১৮৫ নং আয়াতে, যেখানে রামানের তাৎপর্য বর্ণিত হয়েছে। তাকবীর :
اللَّهُ أَكْبَرُ، اللَّهُ أَكْبَرُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ، اللَّهُ أَكْبَرُ، وَلِلَّهِ الْحَمْدُ
(আল্লা-হু আকবর, আল্লা-হু আকবর, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়াল্লা-হু আকবর, আল্লা-হু আকবর, ওয়া লিল্লা-হিল হামদু)
আল্লাহ সবচেয়ে মহান, আল্লাহ সবচেয়ে মহান, আল্লাহ সবচেয়ে মহান, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই, এবং আল্লাহ সবচেয়ে মহান, আল্লাহ সবচেয়ে মহান, এবং সকল প্রশংসা আল্লাহ’র জন্য- মুছান্নাফে আবী শায়বাহ ৫৬৩৩ হাদীসটি সহীহ।

কতিপয় বর্জনীয় আমল:
১. ঈদের দিন সিয়াম পালন করা- সহীহ মুসলিম ঈদের দিন সিয়াম পালন করা নিষেধ অধ্যায় ১১৩৮। কোন প্রকার মানত রোযাও রাখা হারাম।
২. ঈদের সালাতের আগে কোন (নফল) সালাত পড়া- সুনানে আবু দাউদ ১১৫৯ হাদীসটি সহীহ।
৩. পা ছুঁয়ে সালাম করা। সালামের সাথে পায়ের কোন সম্পর্ক নেই, হাত ও পায়ের সাথে সালামেরও কোন সম্পর্ক নেই। এটি একটি ভাইরাল, যা কতিপয় মুসলিম পরিবারে প্রচলিত অনৈসলামিক সংস্কৃতি। সালাম এটি আল্লাহ’র একটি গুণাবাচক নাম ও ইসলামী সম্ভাষণ। সালামের সাথে হাত উঠানো ও পা ছুঁয়ার কোন বিধান ইসলামে নেই। (হ্যাঁ কেউ দূরে থাকলে মুখে উচ্চারণপূর্বক হাত তোলা যেতে পারে)। রাসূল (স)কে কোন সাহাবী (রা) বা কোন সাহাবীকে কোন তাবিঈ, বা কোন তাবিঈকে তাবে তাবিঈ অথবা কোন ইমামকে তাঁদের কোন ছাত্র বা অনুসারি পা ছুঁয়ে সালাম বা সম্মান করেছেন এমন নজীর কুরআন ও হাদীসের কোথাও নেই। তবে মুসাফাহা (হ্যান্ডশেক) ও মুআনাকা (কোলাকুলি) করা যেতে পারে, আবার এটিও শুধু ঈদের দিনগুলোর জন্য নির্দিষ্ট কোন আমল নয়, বরং সর্বাস্থায়।
৪. নারী পুরুষ অবৈধ মেলামেশা করা,
নারী পুরুষ অবৈধ মেলামেশা সর্বাবস্থায় হারাম। মুহাররমাত তথা যাদেরকে বিয়ে করা যায়না, তাদের সাথে যেভাবে চলাফেরা করা যায়, একইভাবে গায়রে মুহাররমাত তথা যাদেরকে বিয়ে করা যায়, তাদের সাথে চলাফেরা সমান নয়। প্রথমটি হালাল দ্বিতীয়টি হারাম। বিস্তারিত জানতে পড়–ন, সূরা নিসা ২৩, সূরা নূর ৩১-৩২ ও ৬১ নং আয়াতের অনুবাদ দেখে নিন।
আমাদের দেশে এ সব বললে অনেকে মৌলবাদি আচরণ বলে! আসলে নিজেদের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে অন্য সংস্কৃতি পালন কি মডেলিং? আমার মতে মডেলিং হচ্ছে, নিজেদের সংস্কৃতি যথাযথভাবে করা। যে যাই বলুক, পরকালের পাথেয় আগে সংগ্রহ করতে হবে।

আসুন, আমাদের প্রতিটি ইবাদাতকে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা সাজিয়ে তুলে নিজেদের আমলকে ভেজালমুক্ত করে আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জন করি।
আল্লাহ আমাদের সকলকে দলীলভিত্তিক আমল সাঁজানোর তাওফিক দিন।

লেখক:
হাফেজ মৌলানা ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব জালাল
লেখক, সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *