চট্টগ্রাম, , শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

admin

পাঠ্যবইয়ে এই লেখা ছাপা হলো কিভাবে?

প্রকাশ: ২০১৭-০৯-২১ ২০:৪৭:৩১ || আপডেট: ২০১৭-০৯-২১ ২০:৪৭:৩১

 

কাফি কামাল: ‘মংডুর পথে’ শীর্ষক একটি ভ্রমণ কাহিনী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অষ্টম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই সাহিত্য কণিকা’য়। কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাস বড়ুয়ার লেখা এ ভ্রমণ কাহিনীর একাধিক জায়গায় আরাকানের রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া অভিবাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে লেখাটি আলোচনায় উঠে এসেছে। ইতিহাসবিদরা বলছেন, পাঠ্যবইয়ে এ লেখাটি নির্বাচন সঠিক হয়নি। এটা পাঠ্যবইয়ে থাকা উচিত নয়। ‘মংডুর পথে’ ভ্রমণ কাহিনীর এক জায়গায় লেখা হয়েছে- ‘ছোটবেলা থেকে চট্টগ্রামের পাশে অপরূপ মিয়ানমারের কথা শুনে এসেছি রূপকথার গল্পের মতো। সারা মিয়ানমারে আমাদের রিকশার বদলে পাইক্যা। স্থানীয় মুসলমানরা এর একচেটিয়া চালক। মংডুর ব্যবসাও প্রায় ওদের দখলে, আর হিন্দুরাও আছে। এরা চট্টগ্রাম থেকে এসেছে, দীর্ঘদিন ধরে আছে।’ অন্য জায়গায় লেখা হয়েছে, ‘ওখান থেকে একটু এগিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলাম। মালকিন বসে আছে চেয়ারে। রোয়াইংগা মুসলিম বয় আছে দুজন। ওরা মূলত চট্টগ্রামের।’ আরেক জায়গায় লেখা হয়েছে, ‘রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো একটা মেয়ে। বাঙালি। লুঙ্গি এবং কোমর ঢাকা ব্লাউজ পরেছে। মেয়েটি দিব্যি চট্টগ্রামী ভাষায় এটা-ওটা আছে জানিয়ে রাখতে লাগলো। ওর নাম ঝরনা। পূর্বপুরুষের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানে।’

ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন লেখাটির ব্যাপারে বলেন, অভিবাসন ইতিহাসের একটি অংশ। আরাকানের যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান তারা কিন্তু শত শত বছর ধরে সেখানে আছে। ওদিক (মিয়ানমার) থেকেও মানুষ আমাদের দিকে এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব জনগোষ্ঠী তারাও কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে এসেছে। আমাদের এখানে নাগরিক হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার অধিকার তাই মিয়ানমার সরকারের নেই। এমনটা করা হলে কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই সমস্যা তৈরি হবে। আমেরিকায় যারা অভিবাসন নিয়েছেন তাদের কি হবে? এটা তো সারা পৃথিবীর রীতিনীতির বাইরে। তিনি বলেন, মংডুর পথে লেখাটির মধ্যে ‘এরা চট্টগ্রাম থেকে এসেছে, দীর্ঘদিন ধরে আছে’ এমন একটি লাইন আছে। রোহিঙ্গারা আরাকানে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে বসবাস করছেন। কিন্তু ‘দীর্ঘদিন’ ধরে শব্দটার অর্থ বেশিদিন নাও হতে (বুঝাতে) পারে। এখন এ লেখাটি পাঠ্যবইয়ে থাকা একটু সমস্যা করবে বলে আমার মনে হয়।

প্রথমত, স্পর্শকাতর পরিস্থিতি এখন। দ্বিতীয়ত, লেখাটার মধ্যে জ্ঞানেরও তেমন কিছু নেই। তাহলে ‘মংডুর পথে’ এখন দরকারটা কী। বিশ্ব সম্পর্কে জানার তো অনেক কিছুই আছে। এ লেখাটা পাঠ্যবইয়ে নির্বাচন সঠিক হয়নি। আমার কথা হচ্ছে, এই লেখাটা অষ্টম শ্রেণির বইতে দেবে কেন? দরকারটা কি? আমি মনে করি, এই লেখাটা বইতে থাকা উচিত নয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর এটিএম আতিকুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা মুসলমানরা চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া অভিবাসী- এ কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে চট্টগ্রামের লোকজন ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি বা নানা কারণে আরাকানে যাওয়ার আগেই আরবদের প্রভাবে সেখানে মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ‘মংডুর পথে’ ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তাতে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের আরাকানে বসতির বিষয়টি প্রকাশ পায় না। এটা জাতীয় স্বার্থবিরোধী। লেখাটি পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা সঙ্গত হয়নি। পাঠ্যবইয়ে রাখাও সঙ্গত হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, দূর অতীতে চট্টগ্রাম ও বর্তমান রাখাইন প্রদেশ এক দেশ ও এক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে থাকার কারণে আরাকানের এক জায়গার লোক অন্য জায়গায় গিয়ে বসতি গড়েছে এটা ঐতিহাসিক সত্য।

ঐতিহাসিকভাবে এটাও সত্য যে, আরাকানের রোহিঙ্গারা সেখানে বসবাস করছেন কয়েক শতাব্দি ধরে। আজকে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে এসেছে, এক সময় চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের রাখাইনরাও কিন্তু সেখান থেকে শরণার্থী হিসেবেই এদেশে এসেছিল। স্বার্থ ও রাজনীতির কারণে এখন যুক্তি ও মানবতা মার খাচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জটিলতা চলছে। ইতিহাসের বিষয়গুলো লেখার সময় যেমন সচেতন থাকা উচিত তেমনি কোনো লেখা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার সময়ও সতর্কতা জরুরি।

নৃতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলার সঙ্গে আরাকানের রয়েছে হাজার বছরের দীর্ঘ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক যোগসূত্র। আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসতি হাজার বছরের পুরনো। ঐতিহাসিক এন এম হাবিব উল্লাহ রচিত ‘রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস’ বইয়ে লেখা হয়েছে, ৭ম শতকে আরব বণিকদের মাধ্যমে আরাকানের সঙ্গে মুসলমানদের প্রথম পরিচয় ঘটে। আরাকানের চন্দ্রবংশীয় রাজবংশের সংরক্ষিত ইতিহাস ‘রদজাতুয়ে’ এ তথ্য উল্লেখ রয়েছে। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ এ সম্পর্কের সূত্রপাত দেখিয়েছেন খলিফা হজরত ওমর বিন আব্দুল আজিজের সময়কালে। নানা ইতিহাসগ্রন্থের সাক্ষ্য মতে, ১৪০৬ সালে মিয়ানমার রাজা আরাকান আক্রমণ করলে রাজা নরমিখলা বাংলার রাজধানী গৌড়ে এসে আশ্রয় নেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তিনি সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করেন। ১৪৩০ সালে গৌড়ের সহায়তায় আরাকান পুনরুদ্ধার করেন।

১৫৩০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১০০ বছর গৌড়ের সুলতানকে কর দিতো আরাকান। ১৫৩০ সালের পর গৌড়ের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগে আরাকান স্বাধীন হয় এবং ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত আরাকান ম্রাউক উ রাজবংশের অধীনে শাসিত হয়। দীর্ঘ এ সময় পর্যন্ত আরাকানের সব শাসক তাদের নামের সঙ্গে মুসলিম উপাধি ব্যবহার করতেন। গৌড়ের অনুকরণে তাদের মুদ্রার এক পিঠে আরবিতে কালিমা ও রাজার মুসলিম নাম ও তার ক্ষমতা আরোহণের সময় উল্লেখ থাকতো। সরকারি ভাষা ছিল ফার্সি এবং সৈনিকদের প্রায় সবাই ছিল মুসলমান। পরে জেকুক শাহ’র আমলে পর্তুগিজ নৌ-সেনাদের সহায়তায় মগদের নিয়ে গঠিত তাদের নৌবাহিনী পরবর্তীতে জলদস্যুতে পরিণত হয়। মগ জলদস্যুরা চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় নির্বিচার লুণ্ঠন আর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এ সময় অগণিত মুসলমান নর-নারী ধরে নিয়ে যায় আরাকানে এবং তাদের দাস হিসেবে বিক্রি করে। এভাবেও বিপুলসংখ্যক মুসলমানের আগমন ঘটে আরাকানে। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা ভোদাপায়া দখল করে নেয়ার পর তাদের অধীনে শাসিত হয় আরাকান। ১৮২৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর সংঘটিত চুক্তিতে আরাকান, আসাম ও ত্রিপুরার ওপর থেকে দাবি প্রত্যাহার করে তৎকালীন বার্মা সরকার। ১৯৪৮ সালে বৃটিশ শাসন থেকে মিয়ানমার স্বাধীন হলে আরাকানকে মিয়ানমারের ভাগেই দেয়া হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা ভোদাপায়া (আরাকান) দখল করে নিয়ে এককালের স্বাধীন আরাকান রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটার পাশাপাশি বর্মী বাহিনীর অত্যাচারে রোহিঙ্গা হিন্দু-মুসলিম, রাখাইন নির্বিশেষে দলে দলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে প্রবেশ করে। বর্মী বাহিনীর হত্যা ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে ১৭৯৮ সালে আরাকানের তিন ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা আশ্রয় নেয় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। ১৯৪৮ সালে বার্মা বৃটিশ কর্তৃক স্বাধীনতা লাভ করার পর পর বিপুলসংখ্যক আরাকানি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আসে। বিশেষ করে মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় দুটি জনগোষ্ঠী চাকমা ও মারমা জনগোষ্ঠী। এছাড়া বৃটিশ আমলসহ বিভিন্ন সময়ে এসব অঞ্চল একই প্রশাসনের অধীনে থাকায় নানা সময়ে নানা জনগোষ্ঠীর মানুষ মিয়ানমারে যেমন গেছে, তেমনি এসেছে বাংলায়। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে বঙ্গ এবং চট্টগ্রাম থেকে যেমন মানুষ আরাকানে গেছে তেমনি আরাকানসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে রাখাইন, চাকমা ও মারমা জনগোষ্ঠীর লোকজন এসেছে বাংলাদেশে। বর্তমানে তারা চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পটুয়াখালীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করছেন। ইতিহাসবিদরা বলছেন, মিয়ানমারের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর নাম। মাত্র দুই দশক আগেও বার্মার মূলধারার রাজনীতি এবং নির্বাচনে ছিল তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। কিন্তু দেশটির সামরিক জান্তা দেশ, রাজধানী, আরাকান, আকিয়াবের নামের মতোই পাল্টে দিয়েছে অনেক কিছুই। সুপরিকল্পিতভাবে মুছে ফেলতে চাইছে একটি জাতিগোষ্ঠীর চিহ্ন। ১৯৮২ সালে বিতর্কিত এক আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার পর রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসী হিসেবে প্রচারণা চালায় দেশে-বিদেশে। তবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মেনে নেয়নি মিয়ানমারের সে অযৌক্তিক দাবি। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে একাধিকবার। ‘মংডুর পথে’ শীর্ষক লেখাটি পাঠ্যবইয়ের জন্য নির্বাচন ও বই ছাপা প্রক্রিয়ার সময় রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি জটিলতার মধ্যেই ছিল বাংলাদেশ।  বাংলা সাহিত্যে বহু সুলিখিত ভ্রমণ কাহিনী থাকা সত্ত্বেও কেন এ লেখাটি বেছে নেয়া হয়েছে পাঠ্যবইয়ে সে প্রশ্ন অনেকের।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *