চট্টগ্রাম, , বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

admin

রাউজানে নিজের ‘নাড়ি-ভুঁড়ি’ কেটে গুজব ছড়িয়ে ভণ্ড ফকিরের কাণ্ড!

প্রকাশ: ২০১৭-০৯-২২ ০৯:৩৫:০০ || আপডেট: ২০১৭-০৯-২২ ০৯:৩৫:০০

বীর কন্ঠ ডেস্ক : নিজের নাড়ি-ভুঁড়ি কেটে বের করে তা পুকুরে পরিষ্কার করে আবার পেটের ভেতর ঢুকিয়েছে’- কথাটি শুনে অবাক লাগলেও এমন ঘটনাই ঘটেছে বলে দাবি করছেন অনেকে। গত বুধবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার মধ্যে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের ঊনসত্তরপাড়া গ্রামের শাহাদুল্লাহ কাজী বাড়িতে এসব ঘটনা ঘটে। এমন উদ্ভট ঘটনায় স্থানীয় জনমনে সৃষ্টি হয় ব্যাপক চাঞ্চল্য।

 

এমন অলৌকিক ঘটনা প্রচার হওয়ার পর ওই আধ্যাত্মিক ফকিরের দোয়া ও পানিপড়া নিতে জমায়েত হয় হাজার হাজার নারী-পুরুষ। তাদের কেউ দেয় টাকা কেউবা ব্যস্ত তার সেবাশুশ্রূষায়। আর সেই ফকির ভক্তের ভিড়ের মাঝে বসে হুঁকা টানায় ব্যস্ত।

 

নিজেকে ৬ বছর আগে থেকেই চট্টগ্রামের ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত আশরাফ শাহ (রঃ) এর অলৌকিক খেলাফত প্রাপ্ত বলে দাবি করছেন তিনি। সে কারণে ঝাড় ফুঁকও করতেন। নানান পেশার মানুষের পাশাপাশি নিয়মিত যাতায়াত করত মহিলারা তার আসনে।

 

সে কারণে দীর্ঘ ৬ বছর ধরেই নানা ভাবে প্রতারণা করে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে দিয়েছেন। নিজেকে লোকদের মাঝে প্রচার করে বেড়াতেন ফকির বাবা বলে। লোকদের দেখানোর জন্য প্রতি বুধবার যেতেন কদলপুর ইউনিয়নে অবস্থিত হযরত আশরাফ শাহ্ (রঃ) এর মাজারে। যাতে করে লোকজনের বিশ্বাস অর্জন করা যায়।

 

প্রতি বুধবারের ন্যায় গতকাল রাতে (২১-সেপ্টেম্বর) তিনি যান হযরত আশরাফ শাহ (রঃ) মাজারে। তবে তিনি এবার প্রতিবার যেভাবে সেভাবে যায়নি। গিয়েছেন চমৎকার একটি নাটকীয়তার অভিনয় করে। তবে অলৌকিক ক্ষমতা দেখিয়ে বড় ফকির সাজতে গিয়ে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি এই ভণ্ড। থানা পুলিশ তাকে আটক করেছে। তার নাম সৈয়দ মো. ছোটন প্রকাশ শাহ (২২)। সে উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের আবু শাহ ফকির বাড়ির মো. শফির ছেলে।

 

সে নিজেকে হযরত আশরাফ শাহ’র খলিফা দাবি করে আসছিল। উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, বুধবার দিবাগত রাত ৩টায় সময় সে ছাগলের নাড়ি-ভুড়ি নিজের পেটের সাথে বেধে পুকুরে ধৌত করছিল। কিন্তু লোকদের বলছিল সে অলৌকিকভাবে তার ক্বলব পরিস্কার করছে। এবং মুহুর্তের মধ্যেই এঘটনা চারিদিকে ছড়িলে পড়লে হাজার হাজার স্থানীয় জনতা ছোটন শাহ’কে (বাবা) দেখার জন্য ভিড় জমায় হযরত আশরাফ শাহ (রঃ) মাজার প্রাঙ্গণে।

 

এক পর্যায়ে ঘটনাটি নাটকীয়তা প্রমাণ হলে লোকজন খবর দেন রাউজান থানায়। পরে পুলিশ পোর্স গিয়ে তাকে গ্রেফতার করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে প্রমাণ হয় কোন অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং সাধারণ মানুষকে ধোকা দেবার জন্য প্রতারণার নিমিত্তে নাড়ি-ভুড়ি পেটে বেধে নাটকের অভিনয় করে। পরে তাকে দুপুরে হাসপাতাল থেকে রাউজান থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

 

রাউজান থানার এসআই মুরাদ বলেন, সকাল ১১টার দিকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি বিপুলসংখ্যক মানুষ ছোটনকে ঘিরে বসে আছে। ছোটনের পেটে একটি বড় ব্যান্ডেজ বাঁধা।

 

এরপর তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসতে চাইলে তার কয়েকজন ভক্ত বাধা দেয়। একপর্যায়ে ছোটনসহ দুই ভক্তকেও নিয়ে আসি। দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসকরা ব্যান্ডেজ খুলে ছোটনের শরীরে কোনো ক্ষতচিহ্ন পাননি। রাউজান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডা. সোনম বড়ুয়া বলেন, ছোটনের ব্যান্ডেজ খুলে এবং পরীক্ষা করে তার শরীরে কোনো ক্ষত পাইনি। সে স্বাভাবিক রয়েছে। তার শরীরে কোনো কাটাছেঁড়াও নেই।

 

ঊনসত্তরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এসকান্দর বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে হজরত আশরাফ শাহর (র.) আস্তানায় গিয়ে দেখি বিপুলসংখ্যক মানুষের মাঝে ছোটন বসে আছে। উপস্থিত লোকজন তার নাড়ি-ভুঁড়ি পেট থেকে বের করে দেখাতে বললে সে তার কয়েকজন ভক্ত দিয়ে তার পরনের গেঞ্জি কাটে। এরপর সে নিজের হাতে পেটের বাঁ পাশে গামছার ভেতর থেকে (পেটের ভেতর থেকে বের করার ভান করে) নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে দেখায়। এরপর ওই নাড়ি-ভুঁড়ি তার ভক্তরা আস্তানার পাশে মাটিচাপা দেয়। তবে কেউ কেউ তার পেটে কোনো কাটা চিহ্ন না দেখে এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে।

 

ছোটনের মা জয়নাব খাতুন ও বড় ভাই আজগর আলী দাবি করে বলেন, আশরাফ শাহ (র.) সূত্রে আবু শাহর বংশধর হিসেবে ছোটন কেরামতি পেয়েছে। সে সুবাদে সে দীর্ঘদিন থেকে চিকিৎসা দিয়ে মানুষকে ভালো করছে।

 

ছোটন শাহ গুজবের ঘটনা অস্বীকার করে বলে, আমি অলির গোলাম। যখন ধ্যানে থাকি তখন ব্লেড, মাটি, গাছ খেতে সক্ষম হই। আমি ধ্যানে থাকার সময় কী হয়েছে বলতে পারি না।

 

নাড়ি-ভুঁড়ি মাটিচাপা দেওয়া প্রসঙ্গে তার উত্তর, কোনো কিছুই মাটিচাপা দেওয়া হয়নি। পেট থেকে নাড়ি-ভুঁড়িও বের হয়নি। পেটে ব্যান্ডেজ সম্পর্কে জানায়, তার পেটে রক্ত দেখে ভক্তরা কিছু ক্ষতি হবে মনে করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। তাবিজ-কবজ দেওয়া সম্পর্কে তার উত্তর, যারা আমার কাছে আসে তাদের চিকিৎসা করি। তাবিজ, পানিপড়া দেই না।

 

কদলপুর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান কমল চক্রবর্তী বলেন, বুধবার রাত ২টার দিকে কদলপুর শমশেরপাড়া এলাকায় মেয়েসংক্রান্ত ঘটনায় স্থানীয় কিছু ছেলে ছোটনকে তাড়া করেছিল। ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ছাগল বা মুরগির নাড়ি-ভুঁড়ি পেটে গামছা দিয়ে বেঁধে সে অলৌকিক ঘটনার গুজব ছড়ায়।

 

জানা যায়, পরিবারের ৪ভাই ১ বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। তার পিতা মো.শফি কৃষি কাজ করেন। বাকি ভাই বিভিন্ন কাজ করেন আর বোন বিবাহিত।

 

ছোটন শাহ’র বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, সে অনেক বড় একজন ভন্ড। আমার নানীর কাছ থেকে ক্যান্সার ভাল হবার নাম করে সে ১০হাজার টাকা নিয়েছিল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তারই গ্রামের মো. ইলিয়াছ নামের এক ছেলে বলে, বিভিন্ন সময় আমরা দেখতাম তার কাছে মেয়েরা বেশি আসত। সে নাকি তাদের তাবিজসহ ঝাড় ফুঁক করে। তবে আমরা এগুলো বিশ্বাস করতাম না। আজকেই ভালো করে বাবা নামের ভন্ডের ভন্ডামীর চিত্র দেখলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *