চট্টগ্রাম, , বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

কাইছার হামিদ

লেকের ধারে পাহাড় পাড়া, মেঘের কোলে স্বর্গীয় লীলা!

প্রকাশ: ২০২১-০৭-২৫ ১৭:২৩:৩৭ || আপডেট: ২০২১-০৭-২৫ ১৭:২৩:৪৪


কাইছার হামিদ: স্বচ্ছ জল, সবুজ, শ্যামল, নীলাভ এখানকার প্রকৃতি। প্রতি ক্ষণে ক্ষণে বদলায় সেই প্রকৃতির রঙ, রূপ ও যৌবন। একেক ঋতুতে হয়ে ওঠে একেক রকম। বিশেষ করে শীতকালে হয়ে উঠে আরও মোহনীয়-মায়াময়। বলছিলাম, আজিজ নগর চেয়ারম্যান লেকের কথা। পাহাড়ের পাদদেশে গড়া উঠা ওই লেক পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার আজিজ নগরে অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসে এখানে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে এ লেকের ছবি ভাইরাল হওয়ায় পর্যটকদের আগ্রহ বেড়েছে। স্থানীয় তরুণরা বিকেলে এ লেকে সময় কাটাতে কাটাতে সেল্পী তুলে এফবিতে লোড দেয়। এত ভাইরাল হয় লেকের প্রকৃতি। আকর্ষণ বাড়ে ভ্রমণ পিপাসুদের এবং প্রকৃতি প্রেমীদের।

সুউচ্চ পাহাড়-টিলার চূড়া থেকে বর্ষাকালে নেমে আসে আঁকা বাঁকা পথ বেয়ে সচ্ছ জল। চারদিকে পাহাড়। পাহাড়ের মোহনায় জলধারার হয়েছে সৃষ্টি। এমন দৃশ্য স্থানীয়রা “ঝিরি” নামে অবহিত করেন। আকবর নামের কোন ব্যক্তির মালিকানাধিন জমি ছিলো বলে এটি “আকবর ঝিরি” নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তিতে, আজিজ নগর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান নাজেমুল ইসলাম চৌধুরী ওই জমির মালিকানা নেন। তিনি “ঝিরি” খনন করে মাছ চাষ শুরু করেন। ওই সময় “চেয়ারম্যান গোদা” নামে পরিচিতি লাভ করে। দীর্ঘ সময় ধরে মাছ চাষ হয় এখানে। প্রতিবছর খনন করতে করতে ব্যাপক আকারে “সমন্বিত মাছ চাষ” শুরু হয়। এ সময়ে “চেয়ারম্যান লেক” নামে চিনে স্থানীয়রা।

চারদিকে সবুজে ঘেরা। দূর পাহাড়ের ওপর সাদা মেঘের ভেলা। আর কখনও কখনও লেকের স্বচ্ছ জলে ভেসে উঠছে পাহাড়সুদ্ধ সেই মেঘের ছবি। ধীরে ধীরে পর্যটকদের আকার্ষন হয়ে ওঠছে “চেয়ারম্যান লেক”। সেল্পী জোনে পরিণত হলো এ লেক। তরুণ তরুণীর ভীড় জমতে থাকে।  দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসা শুরু করে। পর্যটকদের উৎসাহ উদ্দীপনায় চেয়ারম্যান পুত্র রিয়াদ স্বপ্ন দেখে একটি পর্যটন স্পট করার। এক দল তরুণদের সাথে নিয়ে স্বপ্নের পথ ধরে হেঁটে চলে।

পাহাড়ের পাদদেশে চেয়ারম্যান লেক। লেকের উপর দিয়ে চলছে বোট। লেকের জল আর পাহাড়ে ঘেরা নয়নাভিরাম দৃশ্য যে কাউকে কাছে টানে। বোটটি ধীরে ধীরে চলে। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে সাঁইসাঁই হিমেল বাতাস বয়ে যায়।

কখনও কখনও লেকের স্বচ্ছ জলে ভেসে উঠছে পাহাড়সুদ্ধ মেঘের ছবি। এখানে পাহাড়-লেক আর মেঘের খেলা, সেই খেলায় রঙের মেলায় মন হারিয়ে যায়। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথের ধারে কয়েকশ’ ফুট নিচে তাকালে ছমছম করে উঠবে শরীর। শীতকালে আগত পাখির কিচির মিচির শব্দ, পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে ওই প্রাঙ্গণ।

ছোট বড় পাহাড়, টিলা আর গিরিপথ নিয়ে গড়ে ওঠা প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি এই লেক। যার সৌন্দর্য লিখে বা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এখানে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস, থাকে উল্লাসের ছাপ। এখানে মেঘ, পাহাড় আর জলাভূমি দেখা যাবে একই সঙ্গে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঘন সবুজের মাঝ দিয়ে চলা ঢালু পথগুলোই অন্য পাহাড়ি পর্যটন থেকে একে করে তুলেছে অনন্য।   
 
বর্ষাকালে এই পাহাড় চূড়ায় উঠে চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার মজাই আলাদা! দূরের লেক পাহাড়ের মাঝে নীলাভ জলরাশি নিয়ে নীরবে গেয়ে যায় সম্প্রীতির গান। বর্ষাকালে লেকের মাঝে ছড়ায় সৌন্দর্যের মুক্তা। আর দূরের পাহাড়ের ভাঁজগুলো টেনে ধরে দু’চোখের চাহনি। বর্ষাকালে পাহাড়ের গাছপালা আর জঙ্গলগুলো সজীব-সতেজ। রাস্তার পাশের সেগুন গাছের বড় বড় পাতা বাতাসের সঙ্গে দোল খেয়ে দারুণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। শীতকালে আবার এসব সেগুনগাছ পাতাবিহীন ন্যাড়া কঙ্কালের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু সেগুনগাছ কেন, পাহাড়গুলোই তো হয়ে পড়ে মলিন-বিবর্ণ। বিকেল বেলায় সাঁঝের ঝিঁঝি পোকার মতো নানা কীটপতঙ্গের গান শোনা যায়। এ যেন অন্য এক দুনিয়া।

গরমকালে দু’পাহাড়ের ফাঁকে সু সু বাতাস গাঁ ভাসিয়ে দেয়। শীতল পরশ গাঁ মেখে মন ভরে যায়। পাহাড়ের ভাঁজগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকে নান্দনিক রূপ নিয়ে। এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে দুপুরের পর ট্রেকিং করা ভালো। মেঘ-পাহাড়ের অনুপম সম্পর্ক উপভোগ করা যায় অনায়াসে। 
সূর্যের তেজ কমে গেলই গৌধূলির আলো, তারপর অন্ধকার। কীটপতঙ্গের গুঞ্জন সন্ধ্যার নীরবতা ভেঙে দিয়ে পাহাড় আর লেক যেন এক সূতোয় গাঁথা। 

চারদিকে পাহাড়ের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য যে কাউকে বিমোহিত করে। অসংখ্য প্রজাতির বনজ, ফলদ আর ভেষজ বৃক্ষরাজির সমারোহ এখানে। প্রেমিক যুগলের নির্মল আনন্দ এ লেক। এ লেকের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর থেকে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে। তবে লেকে প্রবেশের জন্য কোন ফি  দিতে হয় না।

পিকনিক স্পট হিসেবে ভ্যানু করতে পারেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কিংবা একা বেড়াতে যেতে পারেন এই নতুন পর্যটন স্পটে। আবার পারিবারিক ভ্রমণের জন্যও চমৎকার জায়গাটি। একা একা চুপচাপ নিজের সাথে সময় কাটাতে চাইলেও ‘চেয়ারম্যান লেক’ মন্দ নয়।

রয়েছে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা। আপনি চাইলে নৌকায় ঘুরে বেড়াতে পারবেন লেকে। তার জন্য আপনাকে একটি নৌকা ভাড়া করতে হবে ঘন্টায় ১৫০/২০০ টাকা করে। চাইলে লেকে নেমে গোসলও করতে পারবেন।

জ্যোৎস্না রাতের মজাই আলাদা এ লেকে। তাবু টাঙ্গিয়ে বাড়তি আনন্দ নিতে পারেন। নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত। রাতের বেলায় ছোট নৌকা নিয়ে লেকে ঘুরে বেড়ানো যায়।

খাবার ব্যবস্থা : লেকের পাশ ঘেঁষে একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। খাওয়ার  আধঘন্টা আগে খাবার মেনু অর্ডার করলেই খাবার পেয়ে যাবেন। তবে লেকে পর্যটকদের  রাত যাপনের জন্য কোন রিসোর্ট এখনো তৈরী হয়নি।

যেভাবে যাবেন: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কস্থ আজিজনগর বাস ষ্টেশনে নেমে গজালিয়া সড়কে জীপ, রিক্সা ও মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়া যায়। রিক্সায়  ৮০ টাকা ভাড়া, মাহিন্দ্রা গাড়ি জনপ্রতি ১৫ টাকা করে নিবে। এ ছাড়া ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল জনপ্রতি  ৩০ টাকা নেয়।

তবে, পর্যটকদের আরো আকর্ষণ করতে নান উদ্যোগ নিতে হবে। পাহাড়ী জনগোষ্টীর জীবন যাপন নিয়ে নানা চিত্র, রিসোর্ট, নৌকা বাড়ানো, ভালো মানের রেস্টুরেন্ট, শিশু-কিশোর উপযোগী নানা ইভেন্টের খেলনা, ক্যাবল কার, ঝুলন্ত সেতু, রেলগাড়ীসহ নানা স্থাপনা স্থাপন করতে হবে। এ লেক ঘিরে অপার পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক: সম্পাদক- বীরকণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *