চট্টগ্রাম, , শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

admin

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় তুলাতলী গণহত্যা

প্রকাশ: ২০১৭-১০-০৮ ০২:৫৮:২৬ || আপডেট: ২০১৭-১০-০৮ ০২:৫৮:২৬

কাফি কামাল, পালংখালী, কক্সবাজার থেকে : উত্তর আরাকানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একটি গ্রাম তুলাতলী। নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও নির্মম নৃশংসতায় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে গ্রামটি। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্রপন্থি মগরা সেখানে সৃষ্টি করেছে নৃশংসতার এক নতুন নজির। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তুলাতলী গ্রামের অর্ধেকের বেশি বাসিন্দা। উত্তর আরাকানের মংডু, বুচিদং ও রাচিদংয়ের যে কয়টি গ্রামের মানুষ সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে তার অন্যতম এ তুলাতলী। 

 

এ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী পাশের ইউনিয়ন ডোয়েলতলীর সাবেক উক্কাডা (চেয়ারম্যান) হাসান বসরী। বর্তমানে উখিয়ার বালুখালী হাকিমপাড়া ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। হাসান বসরী বলেন, প্রতিদিনই কয়েকটি গ্রামে সেনা অভিযান চালানোর খবর পাচ্ছিলাম। ঈদের চারদিন আগে আমাদের ডোয়েলতলী গ্রামে অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। সে অভিযানে বেশিরভাগ বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। আহতের সংখ্যা বেশি হলেও নিহত হন ১০-১২ জন। সেদিন পাশের গ্রাম তুলাতলীর দিকে পা বাড়ায়নি সেনাবাহিনী। তিনদিন পর ঈদুল আজহা।

 

উত্তর মংডুর এ গ্রামটি আকারে যেমন বড় তেমনি সেখানে বসবাসরত মুসলিমদের সংখ্যাও বেশি। সবচেয়ে বড় বিষয় এ গ্রামে এমন একজন আলেমের বাড়ি যাকে খোদ সেনাবাহিনীও সম্মান করতেন। শর্তোধ্ব এ আলেমের নাম মাওলানা আহমদ হোসেন। মংডু নয়, তার ছাত্ররা রয়েছেন পুরো আরাকানজুড়ে। অভিযানের প্রথম দিকে সেনাবাহিনী একবার তুলাতলী গ্রামে এসে আরসা’র খোঁজ-খবর নিয়েছিল। জেনেছি, সেখানে তেমন কাউকে না পেয়ে শান্তিপূর্ণভাবেই তারা ফিরে গিয়েছিল।

 

এছাড়া আমাদের ডোয়েলতলী গ্রামে অভিযানের দিন সেনাবাহিনী তুলাতলীর দিকে পা না বাড়াতে সবাই ধরেই নিয়েছিল আপাতত নিরাপদ তুলাতলী গ্রাম। ফলে আশপাশের গ্রাম থেকেও অনেক মুসলিম পরিবার আত্মীয়তার সূত্রে অবস্থান নিয়েছিলেন এ গ্রামে। হাসান বসরী বলেন, চারদিকে স্থানীয় রাখাইন ও বহিরাগত মগদের নৈরাজ্য এবং সেনাবাহিনীর কারণে বেশিরভাগ মানুষই অবস্থান করছিলেন গ্রামে। তুলাতলীর বর্তমান মগ চেয়ারম্যান তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমাদের গ্রামে যেদিন অভিযান হয় সেদিন রাতেই খবর পেলাম সেনাবাহিনী তুলাতলী গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। মগ চেয়ারম্যান তেমন তথ্য জানিয়ে গ্রামের মানুষকে সকালে খালের ধারে বালুচরায় জড়ো হতে বলেছেন। আমি যেহেতু এককালে চেয়ারম্যান ছিলাম, অন্যদের চেয়ে আমাকে বেশি সতর্ক থাকতে হতো।

 

সেদিন পরিস্থিতি বোঝার জন্য আমি নদীর অপরপাড়ে জঙ্গলের আড়ালে অবস্থান নিয়ে তুলাতলীতে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করছিলাম। হাসান বসরী বলেন, বুধবার বেলা তখন সকাল ৯টা। গ্রামের মূল রাস্তা বেয়ে তুলাতলীতে আসে সেনাবাহিনী। একই সঙ্গে পাশের খাল বেয়ে এসে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে মগদের তিনটি সশস্ত্র দল। সশস্ত্র মগদের দলকে নদীর দিক থেকে তুলাতলী ঢুকতে দেখার পর আমার আন্দাজ হয় খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমি খালের পূর্ব পারেই ছিলাম। উঁচু জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ে আত্মগোপন করলেও চোখ রেখেছিলাম তুলাতলী গ্রামে। খালের অপর পাড়ের সমতল ভূমিতেই তুলাতলী গ্রাম। তারপর বেলা গড়ানোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার চোখের সামনেই ঘটলো তুলাতলী গণহত্যা। সেনাবাহিনী গ্রামে ঢুকছে শুনেই লোকজন ভয়ে দিগ্বিদিক পালাতে শুরু করল। কেউ ধানক্ষেতে, কেউ খালের খাদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। কিন্তু সে চেষ্টায় সফল হতে পেরেছে কিছু মানুষ। পালানোর সময় যারাই মগদের সামনে পড়েছে তারাই নিহত হয়েছে। সেনাবাহিনী গুলি করে, মগেরা কুপিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গ্রামবাসীদের হত্যা করেছে উৎসবের মতো। শিশু বাচ্চাদের ছুড়ে ফেলা হয়েছে পাহাড়ী ঢলের পানিতে।

 

পাহাড়ের ওপর থেকে খালের ওপারে হত্যাকাণ্ড দেখলেও সেখানে কতজন মারা গেছেন তার খোঁজ নেয়া সম্ভব ছিল না। গ্রামের অধিবাসীদের সংখ্যা বিবেচনা এবং বেঁচে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে যে ধারণা পেয়েছি, তাতে তুলাতলীতে নিহতের সংখ্যা ১৭শ’র মতো হবে। এ সংখ্যা আপাতদৃষ্টিতে এতটাই অবিশ্বাস্য যে, কোনোদিন রোহিঙ্গারা আরাকানে ফিরতে পারলেই কেবল বিশ্ববাসী তার যথার্থতা জানতে পারবে। হাসান বসরী বলেন, বাংলাদেশে আসার পর তুলাতলী হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে আসা কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, তুলাতলী গ্রামে ঢুকেই সেনাবাহিনী প্রথমে বড় মাওলানা আহমদ হোসেনের বাড়িতে যায়। মাওলানাকে উঠোনে এনে গুলি করলেও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় জবাই করে হত্যা করা হয়।

 

তার পরিবারের ১১ জন সদস্যের মধ্যে একজনও বাঁচতে পারেননি প্রাণে। মাওলানাকে সপরিবারে হত্যার পর গ্রাম থেকে বেছে বেছে ৪০-৫০ জন সুন্দরী যুবতী মেয়েকে আলাদা করা হয়। তাদের ৫জন করে এক একটি বাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে প্রথমে ধর্ষন করেছে সেনাবাহিনী ও কিছু লম্বাচুলের মগ। পরে বাইরে খিল আটকে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় সেসব বাড়ি। সেখানে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয় সে সব ধর্ষিত মেয়েদের। বাড়ি আগুনে পুড়ে যাওয়ার সময় তিনটি মেয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে ধানক্ষেতে ঢুকে পড়েছিল। তারা ধর্ষিত এবং আগুনে পোড়া অবস্থায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে। বর্তমানে তাদের ঠাঁই মেলেছে কুতুপালং নতুন ক্যাম্পে। হাসান বসরী বলেন, মেয়েদের হত্যার পর গ্রামবাসীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে নিহত গ্রামবাসীদের মরদেহগুলো টেনে হিঁচড়ে খালপাড়ের বালুচরায় জড়ো করা হয়।

 

সেখানে আট-দশটির মতো গর্ত করে সে গর্ত ভরা হয় রোহিঙ্গাদের মৃতদেহে। সে গর্ত ভরে যাওয়ার পর চিতা সাজানোর মতো মৃতদেহগুলো একটির উপর একটি রেখে বড় বড় স্তূপ করা হয়। তারপর সেখানে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এ গ্রামের যারা ধানক্ষেত ও পাহাড়ে লুকিয়ে পড়তে পেরেছিলেন তারাই বাঁচতে পেরেছেন কেবল। হাসান বসরী বলেন, ঘটনার ভয়াবহতা ও আতঙ্কে পাহাড়ের যে ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাথরের মধ্যে বসেছিলাম, সেদিন রাত দুটোর সময় যখন পাহাড় থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের খাদ ও আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের দিকে রওনা দিই তখনও দাউ দাউ করে ঝলছিল সে মৃত মানুষের স্তূপ। তীব্র গন্ধে ভরে গিয়েছিল চারদিক। কারবালার কথা শুনেছি, তুলাতলীর ঘটনা কারবালাকে হার মানাবে।

 

হাসান বসরী বলেন, আমাদের ডোয়েলতলীতে অভিযান হবে খবর পেয়ে আগেই আমাদের অনেকের পরিবার আশপাশের পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল। গ্রামের অন্যান্য পরিবারের মানুষের স্রোতে মিশে বাংলাদেশে চলে আসে আমার পরিবার। ঘটনার দিন রাত ২টার সময় পাহাড় থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা দেই। পথে কোয়াংছি বন এলাকায় এক রাত অবস্থান করে ঈদের দিন সকালে আমি আঞ্জুমানপাড়া হয়ে বাংলাদেশে ঢোকার পর এদেশেই ঈদের নামাজ পড়েছি। বাংলাদেশে পৌঁছে আমার পরিবারকে খুঁঁঁজে পেয়েছি। হাসান বসরী বলেন, তুলাতলীর বড় মাওলানা আহমদ হোসেন ছিলেন মংডুসহ উত্তর আরাকানে মুসলমানদের সম্মান, সাহস ও মনোবলের উৎস। তিনি সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মনোবল ভেঙে যায়। এরপর সবাই নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পিঁপড়ের সারির মতো রওনা দেয় বাংলাদেশের পথে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *