চট্টগ্রাম, , শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

admin

বৈসাবি’র সাজে রঙিন খাগড়াছড়ি

প্রকাশ: ২০১৮-০৪-১১ ০০:২৫:১৭ || আপডেট: ২০১৮-০৪-১১ ০০:২৫:১৭

 

শংকর চৌধুরী,খাগড়াছড়ি:

উপতাক্য, ঝরণা, নদী, পাহাড়ী ঝিরি, সর্পিল পথ, উচুঁ পাহাড়, বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ আর বিস্তৃত সংরক্ষিত বনাঞ্চল নিয়েই বৈচিত্র্যময় পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভারত আর মিয়ানমারের সীমান্তঘেষা বিশাল এই বনাঞ্চল এবং পাহাড় আর সমতল ভূমি নিয়ে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান পার্বত্যাঞ্চল। আয়তনে প্রায় এক দশমাংশ। এই অঞ্চলে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, মুরুং, খুমিসহ প্রায় ১৪টি জাতি গোষ্ঠীর বসবাস।

পহেলা বৈশাখে পার্বত্য চট্টগ্রামে মূল উৎসব বৈসাবি। এখানে প্রাকৃতিকভাবে যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ তেমনি এ অঞ্চলে বসবাসরত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন-আচরণ, প্রথা, উৎসব, ধর্মীয় রীতিনীতির রয়েছে স্বতন্ত্র্যতা। বৈসাবি উৎসবকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে নানা আনুষ্ঠনিকতা।

বাংলা নববর্ষের পাশাপাশি উদযাপিত হবে পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব। বাঙালিদের কাছে বৈশাখ শুধুই একটি সামাজিক উৎসব। কিন্তু পাবত্যাঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়িদের বর্ষবরণে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। আর পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব হলো এই বৈসাবি। এখানে উৎসব সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেই। চাকমা ভাষায় বৈসাবি উৎসবকে বিঝু, ত্রিপুরা ভাষায় বৈসুক, মারমা ভাষায় সাংগ্রাই, বলা হয়ে থাকে। প্রধান তিন সম্প্রদায়ের প্রাণের এই উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর নিয়েই তাই এই উৎসবকে বলা হয় ‘বৈসাবি’ উৎসব।

বিঝু: উৎসবের প্রথম দিন চাকমাদের ফুল বিঝু, চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ থেকে শুরু হয়ে বৈশাখ মাসের বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনসহ তিন দিন ধরে চলে এই আয়োজন। এই দিনে ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়। বন থেকে সংগ্রহ করা বিঝু ফুল ছাড়াও মাধবীলতা, অলকানন্দা, নিম পাতা, রঙ্গন, জবাফুলসহ বাহারি ফুল নিয়ে, ভোরের আকাশে রক্তিম সূর্যের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে কলাপাতায় করে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে। দেবী গঙ্গার উদ্দেশ্যে নদীর পাড়ে মোমবাতি জ্বালানো হয়। ফুল বিঝু মূলত চাকমাদের উৎসব হলেও, সবার অংশগ্রহণে তা সার্বজনীন রূপ নেয়।

 

দ্বিতীয় দিন ‘মূল বিঝু’, এই দিন প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে নানান পদের বাহারি সবজি দিয়ে রান্না করা হয় ঐতিহ্যবাহী ‘পাজন’। এতে কমপক্ষে ২০ ধরনের শাকসবজি দিয়ে তৈরি করা হয়। এই পাজনে যে যত পদের সবজি মেশাতে পারবে, তার গুরুত্ব তত বেশি। বানানো হয় নানা ধরনের পিঠা-বিনি পিঠা, স্যানা পিঠা, বড় পিঠা উল্লেখযোগ্য। আর তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গেজ্যা পেজ্যা দিন’ বলা হয়। এই দিনে দলবেঁধে মন্দিরে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়।

সাংগ্রাই: মারমাদের বর্ষপঞ্জিকা বর্মী বর্ষপঞ্জিকাকে অনুসরণ করেই করা হয়। মারমাদের বর্ষপঞ্জিকাকে “ম্রাইমা সাক্রঃয়” বলা হয়। “ম্রাইমা সাক্রঃয়” এর পুরনো বছরের শেষের দুই দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিনসহ ৩ দিন মারমারা সাংগ্রাই হিসেবে পালন করে থাকে। পেঙছোয়াই, (ফুল সাংগ্রাই) প্রধান সাংগ্রাই আর পানি খেলার সাথে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোও অনুষ্ঠিত হয়। সাংগ্রাই এর প্রধান আকর্ষন হল পানি খেলা যেটিকে মারমা ভাষায় “রি আকাজা” বলে। সাংগ্রাই আসলেই পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়াকেই বোঝায়। আর তাই মারমারা এক আনন্দঘন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আর্শীবাদ আর শুভাকাঙ্কার আশায় নতুন বছর উদযাপন করে থাকে।

প্রধান সাংগ্রাইতে, সকাল বেলা সকলে মিলে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে ভগবান বুদ্ধের মুর্তিকে পবিত্র পানি দিয়ে পরিষ্কা পরিচ্ছন্ন করা হয়। আর এর পরেই শুরু হয় ধর্মদেশনা। বিহারের প্রধান বৌদ্ধ ভিক্ষু নতুন বছরের শুভদিনের জন্য ধর্মদেশনা দেই। সেই সাথে নতুন বছরের দিনগুলো যেন শুভাকাঙক্ষায় পরিপূর্ণ হয় তার জন্য ভগবানের কছে প্রার্থনা করা হয়। ধর্মদেশনার পর বৌদ্ধ বিহারে সকলেই ভগবানের উদ্দেশ্যে মোমবাতি ধুপকাঠি জ্বালায়। আবার কেউ কেউ তাদের পূর্বপুরুষদের জাদিতেও মোমবাতি প্রজ্বলন করে।

এভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে পানি খেলা ছাড়াও ওইদিন সবার হাতেই একটা করে পানির পাত্র থাকে। যার যাকে মন চায় সে তাকেই পানি ছিটাতে পারবে, এতে কেউ কোন আপত্তি করে না বরং এটিকে আর্শিবাদ আর শুভ লক্ষনের প্রতীক হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

বৈসুক: ত্রিপুরাদের বৈসুক বা বৈসু পালিত হয় ত্রিপুরা তালাং মাসের ৩০ তারিখ। বৈসুতে আয়োজন করা হয় ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী গড়িয়া নৃত্য। হারি বৈসু: চৈত্র সংক্রান্তির পূর্ব-দিনে এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিন এরা আগামী দিনের সুখ ও সম্পদেরভ জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থন করে। নদীর তীরে, মন্দিরে, বিশেষ পবিত্র স্থানে ফুল, ধুপ এবং দীপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এই দিনে বিশেষভাবে গবাদি পশুর পরিচর্যা করে। পশুদের পানি দিয়ে পরিষ্কার করে গলায় মালা পরায়। এরপর কিশোর কিশোরীদের ফুল নিয়ে খেলা শুরু হয়। এছাড়াও পাড়া প্রতিবেশীদের ফুল উপহার দেয়।

 

বৈসুমা: চৈত্র সংক্রান্তিতে এই উৎসব করা হয়। এ দিনকে বলা যায় খাদ্য উৎসব। এদিন তারা পুরানো বিবাদ ভুলে গিয়ে পরস্পরের বাড়িতে মিষ্টান্নসহ নানা ধরনের মুখোরোচক খাবার পাঠায়। এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ জনপ্রিয় ‘গণত্মক বা পাচন’। এর পাশাপাশি থাকে নানা ধরনের পিঠা, বিভিন্ন ধরনের ফলমূল। এছাড়া ২৫ থেকে ৩০ ধরনের সবজির সংমিশ্রণে তৈরি হয় বিশেষ ধরেনর খাবার। এদিন দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিতরণও কওে অনেকে। গ্রামের মানুষ গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ায় এবং পরস্পরে কুশালাদি বিনিময় করে। এই দিনে সকল শ্রেণির মানুষ সাধ্যমত সাজগোজ করে থাকে।

 

বিসিকাতাল: এই দিন নববর্ষকে বরণ করা হয়। নববর্ষের প্রথম দিনে এরা আগমী দিনের সুখ ও সম্পদের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। এ দিনের বিশেষ আয়োজন থাকে ফুল ও পানি নিয়ে খেলার আয়োজন। বিশেষ করে পানি নিয়ে খেলাটা উৎসবটি বৈসুর প্রধান আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য পানি দিয়ে পুরানো দিনের সকল গ্লানি ধুয়ে দেয়া। এছারাও মা-বাবা এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের পানি দিয়ে স্ন্যান বা গোসল করিয়ে দিয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ কামনা করা উল্লেখ যোগ্য।

আদিবাসী ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, পানিখেলা, ত্রিপুরাদের গরিয়া নৃত্য, ঘিলাখেলা, বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রায় নতুন বছরকে বরণ করা প্রস্তুতি শেষে। পুরাতন বছরের সকল গ্লানি আর অপ্রাপ্তি ভুলে নতুন বছরের ছন্দে পাহাড়ের উৎসবের বর্ণিতায় ফিরে আসে বৈসাবি। সবুজ পাহাড় যেন রঙিন রূপে সেজে উঠেছে। চলছে সর্বত্র উৎসবের আমেজ পাহাড়ে।

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে বৈসাবিকে বরণ করতে নানা আয়োজন করেছে, পার্বত্য জেলা পরিষদ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, মারমা উন্নয়ন সংসদ ও জেলা প্রশাসন। এছাড়া পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে বৈসাবি উপলক্ষে বের করা হবে বর্ণিল শোভাযাত্রা। বৈসাবি বরণ করে নিতে প্রস্তুত খাগড়াছড়িসহ গোটা পার্বত্য অঞ্চল।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *