চট্টগ্রাম, , শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

admin

ইয়াবার কালো থাবা : সর্বাত্মক সামাজিক প্রতিরোধেই মুক্তি

প্রকাশ: ২০১৮-০৬-১০ ১৮:৪৩:৩৪ || আপডেট: ২০১৮-০৬-১০ ১৮:৪৩:৩৪

ডা. মোহাম্মদ লোকমান :

ইয়াবা, বর্তমানে টক অব দি বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত এই ইয়াবা একটি থাই শব্দ যারা অর্থ পাগলা ওষধ।এর মূল উপাদান মেথঅ্যাম্ফিটামিন যা একসময় সর্দি ও নাক বন্ধের ওষধ হিসেবে বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হত।

দীর্ঘক্ষণ জেগে থাকার জন্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিকেরাও এটি ব্যবহার করত। ক্ষিধে কমিয়ে দেয় বলে ওজন কমানোর ওষধ হিসেবেও কিছুকিছু দেশে এর প্রচলন ছিল। এছাড়া দীর্ঘযাত্রার ড্রাইভারেরা তন্দ্রাহীন থাকার জন্যেও একসময় এই ড্রাগ সেবন করত।

তবে এর জীবননাশী ব্যাপক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সমুহ উদঘাটিত হওয়ার পর হতে বর্তমানে বিশ্বের কোন দেশে ওষধ হিসেবে এর ব্যবহারের অনুমোদন নেই।

মেথাম্ফিটামিনের সাথে মস্তিষ্ক উদ্দীপক ক্যাফেইন মিশিয়ে ট্যাবলেট অাকৃতির ইয়াবা তৈরি করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নেশা জাতীয় বস্তু হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সর্বনাশা এই ইয়াবা। পরিবহনে সুবিধা, সহজলভ্যতা এবং সেবন করতে সুবিধার জন্যে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান মাদকে পরিনত হয়েছে ‘বাবা’ হিসেবে বহুল পরিচিত এই পাগলা ওষধ বা ক্র‍্যাজি মেডিসিন।

কোত্থেকে আসে এই ইয়াবা:

বিশ্বের ৬০ ভাগ ইয়াবার উৎপাদন হয় আমাদের প্রতিবেশী রাস্ট্র মায়ানমারে। এছাড়া থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারত, আমেরিকা সহ আরো অনেক দেশে ইয়াবা উৎপাদিত হয়। আমাদের দেশে সিংহভাগ ইয়াবা আসে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বার্মা হতে। বাংলাদেশের ব্যাপক চাহিদাকে টার্গেট করে শুধুমাত্র  সীমান্ত রাজ্য আরাকানেই নাকি স্থাপিত হয়েছে কয়েকশত ইয়াবা তৈরির কারখানা। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরেও বেশ কিছু ইয়াবা তৈরির কারখানা আছে বলে মাঝেমধ্যে শুনা যায়।

কিভাবে কাজ করে ?

ইয়াবার মুল কাজ হচ্ছে মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করা।

এটি সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব যন্ত্রণা। কিছুসময়ের জন্যে সেবনকারীকে নিয়ে যায় এক স্বপ্নিল জগতে। ইয়াবার প্রচণ্ড উত্তেজক ক্ষমতা আছে বলে একসময় শুধুমাত্র যৌন-উত্তেজক হিসেবেই এটি ব্যবহৃত হত। ক্ষুধা কমিয়ে দেয় বলে স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবেও অনেকে শুরু করে ইয়াবা সেবন। ঘুম কমিয়ে দেয় বলে নাইট পার্টি শুরর আগে ক্লান্তিহীন উপভোগ নিশ্চিত করতে অনেকের পছন্দ ইয়াবা।কিন্তু এই সাময়িক আনন্দের ট্যাবলেটটি যে তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তা টের পাওয়ারও অবকাশ সে সময় তাদের থাকে না।

প্রথমে কম ডোজে এ ট্যাবলেট কাজ করলেও ধীরে ধীরে ডোজ বাড়াতে হয়। আগে যে পরিমাণ ইয়াবা আনন্দ এনে দিত, পরে তাতে আর হয় না। বাড়তে থাকে ট্যাবলেটের পরিমাণ, ক্ষণস্থায়ী আনন্দের পর দেখা দিতে থাকে ক্ষতিকর নানা উপসর্গ।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি কি?

রাত কাটে নির্ঘুম, ইয়াবার প্রতিক্রিয়ায় টানা সাত থেকে ১০ দিন পর্যন্ত অনেকেই জেগে থাকতে বাধ্য হয়। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, গলা-মুখ শুকিয়ে আসতে থাকে অনবরত। প্রচণ্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়তে থাকে। নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। দীর্ঘদিনের আসক্ত ব্যক্তিরা উচ্চরক্তচাপের রোগী হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের ভেতরকার ছোট রক্তনালিগুলো ক্ষয় হতে থাকে, এগুলো ছিঁড়ে অনেক সময় রক্তক্ষরণ শুরু হয়। স্মৃতিশক্তি কমে যায়, মানসিক নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুরের প্রবণতা বাড়ে। পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্র বা পারিবারিক জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা পিছিয়ে পড়তে থাকায় আসক্ত ব্যক্তিরা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। ভালমন্দ বিচার করার ক্ষমতা লোভ পায়।

কারও কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

প্রধান প্রধান অঙ্গ সমুহ একসময় অকেজো হয়ে যায়। এভাবে ইয়াব সেবনকারীরা অকাল মৃত্যুর পথে অগ্রসর হয়।

নেশা ছাড়তে চাইলেও ছাড়া যায় না কেন?

ইয়াবার পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি আসক্ত ব্যক্তিরা এর ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একবার ইয়াবা নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা বা নির্দিষ্ট সময় পর আবার না নিলে শরীরে ও মনে নানা উপসর্গ দেখা দেয়, ফলে বাধ্য হয়ে আসক্ত ব্যক্তিরা আবার ফিরে যায় নেশার জগতে।

  • প্রতিরোধের উপায়:

প্রতিকারের চেয়ে এক্ষেত্রে প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াটাই জরুরী। কারন একবার যদি কেউ ইয়াবাতে আসক্ত হয়, তবে সেই পথ থেকে তাকে ফেরানো দুঃসাধ্য ব্যাপার। শুধু  ইয়াবা সেবনের প্রতি নয়, ইয়াবা ট্যাবলেটের ব্যবসার প্রতিও কিন্তু হতাশাগ্রস্ত বেকার যুবসমাজের আগ্রহ দিনদিন বাড়ছে। কারন রাতারাতি টাকার কুমির বনে যাওয়ার রঙিন হাতছানি রয়েছে এই ব্যবসায়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ইয়াবার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করছে, যাহা নিঃসন্দেহে প্রসংশার দাবীদার। তবে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের মাধ্যমে বেশ কিছু নিরীহ মানুষ এই অভিযানের বলি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যাহা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। মাদক নির্মূলের নামে বিচার বহির্ভূত কোন হত্যাকাণ্ড কখনো কাম্য হতে পারেনা। ইহা মাদকবিরোধী চলমান অভিযানকে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কতা জরুরী। এক অপরাধকে দমাতে গিয়ে অন্য কোন মানবতা বিরোধী অপরাধ যেন সংগঠিত না হয়।

আসলে এই সর্বনাশা ইয়াবা প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতা এবং সামাজিক আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। মাদকাসক্তির কারনগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে সেই কারনগুলো নিয়েই আমাদেরকে কাজ করতে হবে।

এক্ষেত্রে পরিবারের ভুমিকাই হচ্ছে আসল। শুধুমাত্র অভিভাবক মহলের সচেতনতা এই মরন নেশার পথে অগ্রসর হওয়া এবং মাদকের কালো থাবা হতে তাদের সন্তানদেরকে রক্ষা করতে বিরাট ভুমিকা রাখতে পারে।

আমরা এতই অসচেতন যে, সবকিছু জেনেশুনে শুধুমাত্র হুজুগের বশবর্তী হয়ে চিহ্নিত মাদকসেবী বা মাদক ব্যবসায়ীকে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করি। টাকার কাছে আদর্শ বিসর্জন দিয়ে মাদকের গডফাদারদের দলীয় নমিনেশন দেয় রাজনৈতিক দল সমুহ। এভাবে চলতে থাকলে কোন অভিযানের মাধ্যমে  কক্ষনো মাদক নির্মূল হবেনা।

রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা যদি না পায় এবং সবক্ষেত্রে মাদকসেবী এবং মাদক ব্যবসায়ীদেরকে যদি সামাজিক ভাবে বয়কট করা যায়, তবে ক্রসফায়ার লাগবেনা এমনিতেই মাদক নির্মূল হতে বেশীদিন দরকার হবেনা।

সব কথার শেষ কথা হচ্ছে- মাদকমুক্ত দেশ গড়তে সবক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার কোন বিকল্প নেই।সকল মাদকদ্রব্যকে সব ধর্মে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে ধর্মীয় বিধিবিধান সমুহ মেনে চলার তাওফিক দান করেন।

 

লেখক : মেডিকেল অফিসার,  চকরিয়া  পৌরসভা,  কক্সবাজার।

 

প্রকাশিত : প্রিয় লোহাগাড়া”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *