চট্টগ্রাম, , শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

Faruque Khan Executive Editor

দোহাজারীকে থানা ঘোষণা করার যৌক্তিকতা

প্রকাশ: ২০১৮-০৭-২৮ ২৩:৩৪:৫৫ || আপডেট: ২০১৮-০৭-২৮ ২৩:৩৯:২৭

এসএম রাশেদ, চন্দনাইশ:

১৯৬৭ সনে তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে দক্ষিণ  পটিয়া ও উত্তর সাতকানিয়া থানার মধ্যস্থল দোহাজারী অঞ্চলের শঙ্খ নদী তীরবর্তী উভয় অংশের ১৭/১৮টি ইউনিয়ন নিয়ে দোহাজারী নাম দিয়ে একটি নতুন থানা সৃষ্টির প্রস্তাব নেয়া হয়েছিল। কিন্তু: রাজনৈতিক গোলযোগজনিত প্রশাসনিক অস্থিরতার কারণে সে প্রস্তাব কার্যকর হতে পারেনি।

১৯৮৫ সনে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের পরিকল্পনাধীন তখনকার সময়ে গঠিত এতদবিষয়ক সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্তৃপ ‘জেলা ও উপজেলা/থানার সীমানা নির্ধারণ কমিশন’ এর নিকট স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠায় দোহাজারী থানার বিষয়ে সুপারিশ করার জন্য। কমিশন এই ব্যাপারে ১৯৮৫ সনের ১১ আগষ্ট জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম এর সম্মেলন কে সর্বস্তরের লোকের উপস্থিতিতে শুনানী গ্রহন করে।  অতঃপর কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব কফিল উদ্দিন মাহমুদ যথারীতি সুপারিশও করেছেন দোহাজারী’কে থানায় উন্নীত করার।

এছাড়া বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার ৫টি উপজেলা নিয়ে দণি চট্টগ্রামে একটি নতুন জেলা সুষ্টির প্রস্তাবও করা হয়। প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি ‘নিকার’ এ ব্যাপারে প্রস্তাব অনুমোদন করে। পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও বাঁশখালী উপজেলা নিয়ে নতুন জেলা সৃষ্টির প্রস্তাবটি করা হয় দোহাজারী থানার আওতা নির্ধারণের দাবি ছিল সাতকানিয়া থানাধীন ৫টি ইউনিয়ন কালিয়াইশ, ধর্মপুর, বাজালিয়া, পুরানগড়, খাগরিয়া এবং চন্দনাইশ থানার অন্তর্গত ২টি ইউনিয়ন দোহাজারী (বর্তমানে দোহাজারী পৌরসভা) ও ধোপাছড়ি এবং সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের হাছনদন্ডী গ্রাম/ওয়ার্ড ও হাশিমপুর ইউনিয়ানের বড়পাড়া অধিত্রে নিয়ে।

উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগের আদমশুমারী মতে সাতকানিয়া থানার লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ (৩,৫০,০০০), চন্দনাইশ থানার লোকসংখ্যা প্রায় দুই লাখ (২,০০,০০০), সরকারি হিসাবে প্রতি বছর ২.৫ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও যদি ধরা হয় তবে বিগত ৬ বছরের হিসেব মতে সাতকানিয়ার জনসংখ্যা চার লাধিক (৪,০০,০০০) এবং চন্দনাইশের জনসংখ্যা প্রায় আড়াই লাখে (২,৫০,০০০) বৃদ্ধি পেয়েছে। এই েেত্র শুধুমাত্র দোহাজারী ইউনিয়নের জনসংখ্যা বর্তমানে পঁয়তাল্লিশ হাজার (৪৫,০০০), ধোপাছড়ি বার হাজার (১২,০০০), হাছনদন্ডী আট হাজার (৮,০০০), খাগরিয়া (৩০,০০০), কালিয়াইশ বিশ হাজার (২০,০০০), ধর্মপুর আঠারো হাজার (১৮,০০০), বাজালিয়া’য় উনিশ হাজার (১৯,০০০), জনসংখ্যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। সে অনুপাতে প্রস্তাবিত দোহাজারী থানার লোকসংখ্যা হবে এক ল একাত্তর হাজার (১,৭১,০০০), চন্দনাইশ উপজেলার লোকসংখ্যা কমে হবে এক লাখ সত্তর হাজার (১,৭০,০০০) এবং সাতকানিয়া থানার লোকসংখ্যা হবে দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার (২,৫০,০০০) এ পর্যায়ে দোহাজারী প্রস্তাবিত থানা/উপজেলার আয়ন হবে ১৫০ (একশত পঞ্চাশ) কিলোমিটার বা ৬০ বর্গমাইল দোহাজারী হাল্কা বসতিপূর্ণ বনাঞ্চল ব্যতীত দোহাজারী বনাঞ্চলের আয়তন হবে বার হাজার বর্গ কিলোমিটার (১২,০০০)।

সুতরাং সাতকানিয়া ও চন্দনাইশের মধ্যবর্তী দোহাজারীতে থানা হলে প্রশাসনিকভাবে তিনটি থানা/উপজেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমে গতিশীলতা আসবে। প্রশাসনিক সহায়তায় প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এতদ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। দোহাজারীর সাথে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলপথ, নদীপথ ও সড়কপথে যে অনুকূল সুযোগ বিদ্যমান তা অর্থনৈতিক বিকাশকে সমৃদ্ধ করেছে। তাছাড়া ভৌগোলিক ও যোগাযোগের অবস্থানগত কারণে দোহাজারী পৌরসভা, ধোপাছড়ি, কালিয়াইশ, খাগরিয়া, ধর্মপুর, বাজালিয়া, পুরানগড়, দণি হাশিমপুর তথা বড়পাড়াকে নদী, পাহাড়ঘেরা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য দোহাজারীকে নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত করেছে। শঙ্খ নদী দোহাজারীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কর্ণফুলির সাথে মোহনা সৃষ্টি করায় দোহাজারী অচিরেই বন্দর শহরে রূপান্তরিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। দোহাজারী হচ্ছে পূর্বাঞ্চল রেল, বাংলাদেশের আখেরি ষ্টেশন। বর্তমানে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ঘুমদুর রেললাইনের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ২০-২১সালে এ সম্পন্ন হলে দোহাজারী হবে যাত্রাবিরতি ষ্টেশন ও বিশাল জংশন। দোহাজারী ভেদ করে চলিষ্ণু চট্টগ্রাম- কক্সবাজার মহাসড়ক (এশিয়ান হাইওয়ে চার লাইন) এই অঞ্চলের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যমে হিসেবে প্রতিভাত হবে। চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়ক পথ ও বান্দরবান-দোহাজারী নৌ পথ পার্বত্য এলাকাকে সমতল জেলার সাথে যোগসূত্রে ঘটিয়ে চলেছে। ‘নিকার’ এর অনুমোদিত প্রস্তাব অনুযায়ী দণি চট্টগ্রামে নতুন জেলার সৃষ্টি হলে দোহাজারী হবে জেলা হেডকোয়ার্টার। পটিয়া ক্রসিং হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি হলেও ভবণসহ দোহাজারী হাইওয়ে থানা হয়েছে। তাছাড়া গত বছর স্থাপিত হয়েছে দোহাজারী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র। ওই তদন্ত কেন্দ্রে ১জন ওসি তন্দন্ত, ২জন এসআই,১জনএএসআই,নায়েক ১জনসহ মোট ২০ পুলিশ সদস্য রয়েছে এছাড়া পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন) চন্দনাইশ জোনের দোহাজারী দায়িত্ব পালন করছেন ১ ইন্সেপেক্টর,১জন এসআইসহ মোট ৭জন পুলিশ কনস্টেবল রয়েছে যা পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক রূপ দান করার ল্েয দোহাজারীকে থানা/উপজেলায় উন্নীত করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। দণি চট্টগ্রামের প্রস্তাবিত নতুন জেলা সদর ও থানা/উপজেলার অবকাঠামো হিসেবে দোহাজারীতে সমসাময়িককালে স্থাপিত হয়েছে ৩২/৩৩ কেভি ও ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাব-ষ্টেশন। নৌ পরিবহন সংস্থার আন্তর্জাতিক সাংকেতিক কেন্দ্র ডেকা চেই রেড ষ্টেশন, বিএডিসি’র সার বীজ ও কৃষি সম্প্রসারণসহ যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের মহকমাভিত্তিক জোন, দোহাজারী হাসপাতাল, সিভিল সাপ্লাই কেন্দ্র (খাদ্য গুদাম), দোহাজারী সড়ক বিভাগ, বন শিল্প কারখানা, সোনালী, জনতা, কৃষি, অগ্রণী, ইউসিবি, ব্যাসিক, ইষ্ট্যান, ব্যাংক এশিয়া, এক্সিম ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক, বীমা, জোনাল ডাকঘর, বনবিভাগের রেঞ্জ অফিস, লবণ ক্রশিং শিল্প, তহসিল অফিস, কোল্ড ষ্টোরেজ এবং স্কুল- কলেজ-মাদ্রাসা তো আছেই। শতাধিক কোটি টাকা ব্যয়ে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক উদ্যোগ নিয়েছে ইউসিবি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল/কলেজ প্রতিষ্ঠার।

উল্লেখ্য যে, দোহাজারী ইতিহাসখ্যাত এক বিশাল জনপদের নাম। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ৯৫১ খৃষ্টাব্দ থেকে বার্মা রাজার শাসন, ১১৬৭ খৃঃ থেকে মগ ও পর্তুগীজ শাসন, ১৪২৫ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৫১৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন খন্ডকালীন সময়ে ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্য, আফগান সুলতান মাহমুদ শাহ ও হাবশী সুলতান গৌড়ের শাসন এবং ১৬০০-১৬৬৬ খৃঃ আরাকান পর্যন্ত দখলের পর থেকে মুঘলের রাজত্বকাল অবধি দোহাজালী ছিল সুবেদার শাসিত রাজধানী। ১৯৩৯-৪৫ ইং পর্যন্ত জাপন ব্রিটিশের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দোহাজারী ছিল বৃটিশের সামরিক ঘাঁটি। ১৯৬৭ সালের জরিপের সূত্র ধরে ১৯৮৮ পর্যন্ত সময়কালে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক ভূগোল ছিল ‘দোহাজারী কাঠের জন্য প্রসিদ্ধ’ এখানে সম্ভাবমনাময় হিসেবে স্থাপিত করা সম্ভব একটি ‘পেপার মিল’ ও ‘জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র’। দণিাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলার স্বার্থ অগ্রাধিকার দিয়ে দোহাজারীর ভৌগোলিক ও যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী দোহাজারীকে থানা/উপজেলা করার জন্য বিভিন্ন যুক্তিক তুলে ধরে সরকারের নিকট জোর দাবি জানিয়েছেন দোহাজারী পৌরবাসী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *