খালেদ হোসেন টাপু রামু(কক্সবাজার) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২০১৯-১০-০৫ ০০:৪২:৩১ || আপডেট: ২০১৯-১০-০৫ ০০:৪২:৪০
খালেদ হোসেন টাপু,রামু
বাংলাদেশী বৌদ্ধদের তৃতীয় সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু ও উপসংঘরাজ,কক্সবাজারের রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহা বিহারের অধ্যক্ষ, একুশে পদকপ্রাপ্ত, উপসংঘরাজ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের আর নেই। দীর্ঘ ৭০ বছরের ভিক্ষু জীবনের অবসান ঘটিয়ে তিনি বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) দিনগত রাত পৌনে একটার দিকে ঢাকা বঙ্গবন্ধু মেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ (পিজি) হাসপাতালে পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। এ মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশের বৌদ্ধ সমাজসহ সর্বমহলে শোকের ছায়া নেমে আসে।
এদিকে শুক্রবার (৩ অক্টোবর) বেলা পৌনে তিনটার দিকে এই বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু সত্যপ্রিয় মহাথেরর মরদেহ রামুতে পৌছে। তাকে বহনকারী এম্বুল্যান্সটি রামু বাইপাসে পৌঁছালে হাজারো বৌদ্ধ নরনারী তাকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাঁর মরদেহ এক নজর দেখার জন্য সেখানে সমবেত হন। এ সময় হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
তাঁর শিষ্য রামু সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, হঠাৎ করে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ১৫ সেপ্টেম্বর তাকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে কেবিন ব্লকের ৩২০ নম্বর কক্ষে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ২১ সেপ্টেম্বর করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিও) নেওয়া হয়। শারীরিক অবস্থার একটু উন্নতি হওয়া মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) তাকে পুনরায় কেবিনে নিয়ে আসা হয়। সেখানে রাত পৌনে একটার দিকে তিনি পরলোক গমন করেন। ২০১৫ সালে সমাজ সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য প্রয়াত এই বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু একুশে পদক লাভ করেন।
এদিকে শুক্রবার বিকালে পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরর মরদেহ রামু বাইপাসে পৌঁছালে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ছুটে যান রামু-কক্সবাজারের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল, রামু উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রণয় চাকমা,রামু থানার ওসি মো. আবুল খায়ের,ওসি তদন্ত মো. মিজানুর রহমানসহ রামুর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তাঁরাসহ বৌদ্ধ নেতৃব্রন্দের নেতৃত্বে মরদেহ রামু বাইপাস থেকে রামু সীমা বিহারে নিয়ে আসা হয়।
জানাগেছে, ১৯৩০ সালের ১০ জুন কক্সবাজারের রামুর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের মেরংলোয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন সত্যপ্রিয় মহাথের। তাঁর বাবা ছিলেন প্রয়াত হর কুমার বড়ুয়া আর মা হচ্ছেন প্রেমময়ী বড়ুয়া। তাঁর গৃহি নাম ছিল বিধু ভূষন বড়ুয়া। ১৯৫০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসাবে উপসম্পদা গ্রহণ করে সত্যপ্রিয় মহাথের নাম ধারণ করেন।
এর পর তাঁর গুরু ভান্তে আর্য্যবংশ মহাথেরর সঙ্গে তিনি চলে যান উখিয়ার ভালুকিয়া বৈজয়ন্তি বিবেকারাম বৌদ্ধ বিহারে। ওই বিহারের অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন পন্ডিত সত্যপ্রিয় । সেখানে কয়েক বছর থাকার পর তিনি পড়াশুনার জন্য মির্জাপুর পালি কলেজে চলে যান। এর পর ১৯৫৪ সালে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য মিয়ানমারে চলে যান। প্রায় ১০বছর পর ১৯৬৪ সালে মিয়ানমার থেকে ফিরে সেই থেকে রামু সীমা বিহারে অবস্থান গ্রহন করেন। সেই থেকে দীর্ঘ ৭০ বছরের ভিক্ষু জীবনে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সত্যপ্রিয় মহাথের ১৯৫৫ সালে মিয়ানমারের ধর্মদূত পালি কলেজে অগ্রমহাপন্ডিত উ. বিশুদ্ধায়ু মহাথের ও প্রজ্ঞালোক মহাথেরর কাছে পালি ভাষা ও বিনয় শিক্ষা লাভ করেন। এ মহান পূণ্যপুরুষ পৃথিবীর বহু ভাষায় পারদর্শী। বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ ত্রিপিটকের বিভিণ্ন অধ্যায় থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন সত্যপ্রিয় মহাথের।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও অসাধারণ সাহসী ভূমিকা রাখেন শ্রীমৎ সত্যপ্রিয় মহাথের। যুদ্ধ-চলাকালীন তিনি এলাকার সহস্রাধিক অসহায় ও নির্যাতিত মানুষকে ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় পুড়িয়ে দেওয়া ঐতিহ্যবাহি পুরাতন সেই কাঠের বিহারে আশ্রয় দেন। এ নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তাঁর বাকবিকণ্ডাও হয়।
এদিকে একুশে পদকপ্রাপ্ত, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার অধ্যক্ষ ও বৌদ্ধ ধর্মীয়গুরু সত্যপ্রিয় মহাথের’র মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন, রাষ্টপতি মো. আবদুল হামিদ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি।
এক শোক বার্তায় তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন এবং দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু সত্যপ্রিয় মহাথের’র অবদান রয়েছে।
এ বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরর প্রয়াণে গভীর শোক, সমবেদনা ও তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেছেন রামু কক্সবাজার আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল। তিনি বলেন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় গুরু পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের শুধু একজন ধর্ম সংস্কারক নন,তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ট সমাজ সেবক। তাঁর মুত্যতে শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নয়, বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা কোনদিন পূরণ হবার নয়।
অন্যদিকে চট্টগ্রামের নন্দন কানন বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক প্রাধনমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া।
এসময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মেরুল বাড্ডা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারের উপাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, বিশিষ্ট কলামিস্ট ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয়সহ চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ধর্মীয় নের্তৃবৃন্দ।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারে একুশে পদকপ্রাপ্ত, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার অধ্যক্ষ ও বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু সত্যপ্রিয় মহাথের’র মরদেহের উপর ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাষ্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষন বড়ুয়া, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাষ্টি এড. দিপকংর বড়–য়া পিন্টু, ভাবনা কেন্দ্র পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিপন বড়–য়া, কক্সবাজার জেলা মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু ও খিষ্টান সম্প্রীতি পরিষদের উপদেষ্টা সাবেক মহিলা সাংসদ খোরশেদ আরা হক , সদস্য সচিব সুরেশ বড়–য়া বাঙ্গালী, নির্বাহী সদস্য ড. নুরুল আছার, নুরুল আলম সরকার ও সাংবাদিক খালেদ হোসেন টাপু।