চট্টগ্রাম, , শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

Faruque Khan Executive Editor

জেলা পরিষদের প্রশিক্ষণ পেয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছে অগণিত বেকার নারী-পুরুষ

প্রকাশ: ২০১৮-০৪-২৯ ১৭:৪৭:০২ || আপডেট: ২০১৮-০৪-২৯ ১৭:৫২:২৩

মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান মিরাজ : 

আমেনা খাতুন। ২ মেয়ে ১ ছেলে। বড় মেয়ের বয়স প্রায় ৭ বছর, আর ছোট ছেলের বয়স মাত্র ১১ মাস। এক মেয়ে দ্বিতীয় ও অপরটি প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই খুব ইচ্ছে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করবে কারণ তারা মুর্খ হয়ে মনে-প্রাণে অনুভব করছে লেখাপড়ার মূল্য। স্বামী রহিম মিয়া রিক্সা চালিয়ে সামান্য যা আয় করে তা দিয়ে সুখে-শান্তিতেই চলছিল তাদের ছোট সংসার। কিন্তু আমচকা এক কাভার্ড ভ্যানের চাপায় একদিন না ফেরার দেশে চলে গেল রহিম ।

সেই থেকে আমেনা বিধবা আর সন্তানরা পিতৃহীন। নিজ বা স্বামীর বাড়িতে অর্থ সামর্থ কিছু নেই বল্লেই চলে। আত্মীয়-স্বজনেরও প্রায় একই অবস্থা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’। ছেলে দু’টি-কে দুই আত্মীয়ের কাছে দিয়ে নিজে কাজ খুঁজতে থাকে। সঙ্গে ছোট বাচ্চা তাই অনেক কষ্টে সামান্য বেতনে বাসার বু’য়ার কাজ শুরু করে। সেখানে চলতে থাকে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম আর গৃহকর্তার লুলোপ দৃষ্টি।

শুভাশীষ দাশ। জন্মের পর হতে সে দেখেনি তার বাবাকে। মায়ের কাছে শুনেছে তার বাবা বিদেশে গেছে অনেক অনেক বছর পূর্বে। তার মা জানে তার বাবা সেখানে বিয়ে করে নতুন সংসার করছে, নাগরিকত্ব নিয়ে সুখেই আছে। নিজের বাবার প্রতি ঘৃণা জন্মাবে এই ভয়ে সন্তানকে কখনু বলেনি একথা। তার মা গার্মেন্টসে চাকুরী করে অনেক কষ্টে সন্তানকে মাধ্যমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি করেছে। হঠাৎ একদিন ফ্যাক্টরীতে কাজ করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে যায় তার মা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কয়েক দিন বিশ্রামে রাখা হয়। খাদ্যাভাবসহ বিভিন্ন রকমের চিন্তায় তার মায়ের শরীরে বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন জটিল রোগ। অর্থাভাবে ঠিক ভাবে তার ঔষধ-পথ্যও চলছে না। শারীরিক দুর্বলতার কারণে তাকে চাকুরী হতে বিদায় করে দেয়া হয়।

ছদ্মনামের এ দু’জন চোখে-মুখে যখন ঘোর অন্ধকার দেখে অনিশ্চিত জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই খবর পায় চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ পরিচালিত দারিদ্র নিরসন ও নারী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের কথা। বুক ভরা আশা নিয়ে ছুটে গিয়ে দেখে জেলা পরিষদের নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় কোটি টাকায় নির্মিত ৪ তলা ভবনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাদের মতো অসহায়-গরীব শত-শত নারী-পুরুষ সেলাই, ব্লক-বাটিক, বুটিকস, এমব্রয়ডারি, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ধরনের কাজের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এ যেন গভীর সমুদ্রে প্রায়মৃত্যুর মুখে পতিত হওয়া মানুষের খড়-কুটো দেখে তা আকড়েঁ বেচেঁ থাকার স্বপ্ন দেখা। একজন সেলাই আর অপর জন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ হতে এভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রতি বছর কয়েক হাজার অসহায়-দুস্থ নারী-পুরুষ স্বাবলম্বীর খাতায় নাম লেখাচ্ছে। আবেদনকারীর সংখ্যা কয়েক গুণ হওয়ার কারণে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব খন্দকার জহিরুল ইসলামের নির্দেশনায় সচিব শাব্বির ইকবাল অত্যন্ত বিচক্ষণতার সহিত ন্যায় বিচারের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থী বাছাই করে থাকেন, ফলে যোগ্য অসহায় ব্যক্তিগণই প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে।

সর্বশেষ গত ২৭ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে ৬৫৪ জন সেলাই, ব্লক-বাটিক, এমব্রয়ডারি-বুটিকস, কম্পিউটার প্রশিক্ষণার্থীর হাতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে সনদ পত্রসহ আত্ম-কর্মসংস্থানমূলক সামগ্রী তুলে দেন। নিজস্ব মিলনায়তনে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সুযোগ্য চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুস সালামের সভাপতিত্বে এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার জহিরুল ইসলামের স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হওয়া আনন্দঘন এ অনুষ্ঠান সচিব শাব্বির ইকবাল পরিচালনা করেন। মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন এমপি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ “বিশ্বে রোল মডেল” হয়েছেন দাবী করে গর্বের সংগে বলেন, বর্তমান সরকার বেকার ও অসচ্ছলদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালের পর এদেশে আর কোন নারী–পুরুষ বেকার থাকবে না মর্মে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এ মহতি অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে জেলা পরিষদের সদস্য কাজী আব্দুল ওহাব, দেবব্রত দাশ, শেখ মোহাম্মদ আতাউর রহমান, শওকত আলম শওকত, আকতার উদ্দিন মাহমুদ পারভেজ, মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন, মহিলা সদস্য দিলোয়ারা ইউসুফ, রেহেনা আক্তার, শাহিদা আক্তার জাহান, এড. উম্মে হাবীবা, সহকারী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রথীন্দ্রনাথ সেন, মুহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া খান, অপু কুমার বড়ুয়াসহ পরিষদের সকল স্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এদেশের অন্যান্য জেলা পরিষদের তুলনায় চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ হতে অকল্পনীয় হারে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং প্রশিক্ষিতদের পরবর্তীতে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সহযোগিতা করা হচ্ছে মন্তব্য করে সভাপতির বক্তব্যে চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিধবা ভাতা ও মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ নারীদের যে সব সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করেছেন তা নজিরবিহীন। সরকারের নির্দেশনায় নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে জানিয়ে আগামীতে এ ধারা আরো বৃদ্ধি করবেন মর্মে জনাব সালাম আশাবাদ ব্যক্ত করেন। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও আত্ম-কর্মসংস্থানমূলক সামগ্রী হাতে পাওয়ার পর অনেককে আনন্দে অশ্রু বিসজর্ন দিতে দেখা গেছে, যা উপস্থিত অনেকের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে।

উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে প্রতি বছর হাজার-হাজার অসহায়-দুস্থ নারী পুরুষ প্রশিক্ষণ নিয়ে বিশেষ করে সারা চট্টগ্রামে তাদের যোগ্য মতো কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এর ফলে তাদের সংসারে ফিরে এসেছে সুখ-শান্তি এবং দেশে বেকারত্বের হার এবং বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম হ্রাস পাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *