admin
প্রকাশ: ২০১৮-০৫-১৮ ০৩:০২:৫৪ || আপডেট: ২০১৮-০৫-১৮ ০৩:০২:৫৪
মুহাম্মাদ ফয়জুল্লাহ:
রমযান মাস যখনই নিকটবর্তী হতে থাকে, ব্যক্তিভেদে মানুষের মাঝেও বিভিন্ন রকম আবেগ অনুভুতির সৃষ্টি হতে থাকে। এক রকম মানুষ তো এমন হয়- রমযান মাসের আসা যাওয়াতে তাদেরও কিছু আসে যায় না। সে না রোযা রাখে আর না অন্য কোন ইবাদতের ‘ঝামেলা’য় নিজেকে জড়ায়। ঘরের কেউ যদি রোযা রাখেও সে তার সাথে ইফতারে শরীক হয়ে যায়। বাইরেও যদি ইফতার পার্টিতে অংশ নেয়ার কোন সুযোগ মিলে তাহলেও সামাজিকতা রক্ষায় অথবা খাবারে নিজের অংশ উসুলের জন্য সেখানে পৌঁছে যায়। অবশ্য ঈদটাকে সব মানুষই খুব গুরুত্বের সাথে উদযাপন করে। ঈদের রাতে যদিও নানা রকম অন্যায় উল্লাসে মেতেও ওঠে তবু ঈদের নামায পড়ে মসজিদে একবার বাৎসরিক উপস্থিতির রসমটা পুরো করে নেয়।
দ্বিতীয় প্রকারের লোক হয় যারা রমযানে অন্তত তিন চারটা হলেও রোযা রাখুক অথবা তাও না রাখুক, কিন্তু ভাবতে থাকে বড়ই কষ্টের মাস আসছে। কঠিন গরমে পিপাসার কষ্ট ও ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে হবে, রাতের ঘুম নষ্ট হবে, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভাবিত হবে, দৈনন্দিনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যহত হবে। এমন লোক রমযানের এক একটি দিন গুনে গুনে মাস পুরা করে। অবশেষে এই মাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাদের এই বাৎসরিক কষ্টও যেন শেষ হয়ে যায়। তারা রমযানের আগে যেমন ছিল, রমযানের পরেও তেমনই থেকে যায়।
আর তৃতীয় প্রকারের লোক তারা হয় যারা রমযানের রোযা পূর্ণ স্বাদ ও আগ্রহের সাথে রাখে। কুরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ, এক একটি দীর্ঘ রুকু সিজদাহ বিশিষ্ট নামায সহ অন্যান্য নফল ইবাদতেরও খুব ইহতিমাম করে। রোযার কষ্ট তো তাদেরও অনুভব হয়, কিন্তু তারা সেই কষ্ট স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি গভীর ভালবাসার সাথে সয়ে নেয়। তারা আশা রাখে- এই কষ্টের বিনিময়ে রবের পক্ষ থেকে যেই বিশাল প্রতিদান মিলবে, সে তুলনায় এ কষ্ট তো অতি নগণ্য। আশা করা যায় যে এমন নেককার বান্দাগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে অতি উত্তম পুরস্কার পাবেন।
চতুর্থ প্রকারের লোক হয় যারা রমযান আসার পূর্বেই রমযানের অধীর অপেক্ষায় দিন কাটাতে থাকে। সে রজব ও শা’বানের এক একটি দিন গুণে গুণে পার করতে থাকে কখন আসবে রমযান!তাদের ঈদ সে মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে যায় যখন রমযানের চাঁদ উদিত হয়। তৃতীয় প্রকারের লোকদের মত এরাও রোযার কষ্টকে সন্তুষ্টচিত্তে সয়ে নেয় এবং সাধ্যের সবটুকু দিয়ে আল্লাহর ইবাদতে ব্রতি হয়। তবে তার প্রকৃত সফলতা এটা অর্জিত হয় যে রমযান মাস তার জন্য হয়ে যায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের মাস।
রোযার এক একটি কষ্ট তার জন্য হয়ে যায় আল্লাহর অনুগ্রহের প্রমাণ। যখন চরম পিপাসায় গোলা শুকিয়ে কণ্ঠনালীতে কাটা বিঁধার মত অনুভব হতে থাকে তখন সে তার রবকে ডাকতে থাকে, হে মালিক! এক এমন শুষ্ক ভূমি যেখানে পানির কোন একটি ফোঁটাও ছিল না আপনি সেখানে পানির স্রোত বইয়েছেন। হে মালিক! পুরোটা জীবন আপনি পানি পান করিয়েছেন কিন্তু আমরা বুঝতে পারিনি যে পানি কত বড় নেয়ামত। আজ যখন শুষ্ক কণ্ঠনালীতে পিপাসার কষ্ট অনুভব করছি , বুঝতে পারছি এই স্বাদহীন পানি সকল স্বাদের খাবারের চেয়ে কত দামী! আমরা এই নেয়ামতের জন্যে আপনার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। যখন ক্ষুধায় তার প্রচণ্ড কষ্ট হতে থাকে, সে বলে- হে মাবুদ! আপনি চাঁদ, সূর্য, বৃষ্টি, বাতাস, সমুদ্র, পাহাড়, নদী এবং জমিন- সবকিছু মিলিয়ে আমাদের জন্য আহার তৈরি করেন! আপনি ভূ-পৃষ্ঠের হাজারো প্রজাতির প্রাণীর জন্য কেবল বিস্বাদ ঘাস উৎপন্ন করেন আর সেখানে এক মানুষের জন্য আপনি হাজারো রকমের সুস্বাদু খাবার প্রস্তুত করেন! আমরা আত্মার গভীর থেকে আপনার বড়ত্ব ও মহত্ব অনুভব করি।
মোট কথা, রোযার প্রতিটি ত্যাগ ও কষ্টের অনুভূতি তাদের জন্য আল্লাহর পরিচয় লাভের নতুন নতুন দরোজা উন্মুক্ত করে দেয়। খাবার-পানীয় থেকে বিরত থাকা অনাহারের প্রতিটি ক্ষণে তার কাছে অনুভব হতে থাকে সে এর চেয়েও উত্তম লাখো নেয়ামতের মাঝেই যেন প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত করছে। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার উৎস মূল থেকে আসা এমন নিরঙ্কুশ পবিত্র অনুভূতি তার চোখ হতে অঝোরধারায় অশ্রু প্রবাহিত করে। তার বুকের ভেতরটা খোদায়ী অনুভবের তাজাল্লীতে চমকাতে থাকে। তার রাতগুলো প্রিয় রবের জিকিরে আলোকিত হয়ে ওঠে। তার সত্ত্বা সেই খোদায়ী জান্নাতের পরমকাঙ্খিত ব্যক্তি হয়- যেখানে কোন ক্ষুধা থাকবে না আর না কোন পিপাসা। যেখানে প্রত্যেক নেয়ামত কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা এবং সীমা ও হিসাব ছাড়া অফুরান পাওয়া যাবে। যেখান থেকে সে কখনো না বের হতে চাইবে আর না কেউ তাকে বের করবে।
এই সকল নেককার মানুষেরা সেই জাহান্নামের কথা ভেবে কেঁপে ওঠে- যেখানে বঞ্চনার সম্ভাব্য সকল পদ্ধতি জমা করা হবে। যেখানে আল্লাহর দরবারে অপরাধী, বিদ্রোহী ও আল্লাহর হুকুমের প্রতি উদাসীনেরা কেউ সুদীর্ঘকাল আর কেউ অনন্ত কালের জন্য নিজেদের অতীতের উপর আফসোসের প্রস্তর বর্ষণ করতে থাকবে- কেমন মূল্যবান সময় তারা পার করে দিয়েছে! সে সকল লোকেরা দুর্দশায় হা-হুতাশি কান্নার বন্যা বইয়ে দিবে- তারা তাদের কেমন দয়াময় প্রতিপালককে পেয়েছিল আর কত নির্দয়ভাবে তাকে ভুলে গিয়েছে!
এই নেককার লোকেরা রোযা অবস্থায় জাহান্নাম থেকে তার প্রভুর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে থাকে। তারা তাদের ভুলের কারণে লজ্জিত হয়। তারা নিজেই নিজের হিসাবগ্রহণকারী হয়ে নিজের চরিত্র ও দায়িত্বের জবাবদিহিতা নেয়। তারা নেক কাজের প্রত্যেক পদ্ধতিকে নিজের জীবনের অংশ বানিয়ে নেয়ার প্রতিজ্ঞা করে। তারা পাপকাজের প্রত্যেক প্রকারকে বিষাক্ত সাপ মনে করে তা থেকে পালায়নের চেষ্টা করে।
এরাই হল সে সকল সৌভাগ্যবান লোক যারা রমযানে তাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করে নিয়েছে। তারাই সে সকল লোক যারা জেনে নিয়েছে যে আল্লাহই প্রকৃত উপাস্য এবং প্রকৃত প্রতিদানদাতাও।
আল্লাহকে এভাবে যারা পায় তারাই প্রকৃতপক্ষে রমযানকে পায়। তারাই আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা। দুনিয়াতেও এবং আখেরাতেও। – পরিবর্তন