চট্টগ্রাম, , শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ওমর ফারুক লেখক/কলামিস্ট

দামে কেনা দামতুয়া

প্রকাশ: ২০১৮-০৯-২৬ ০০:৪৬:৫৭ || আপডেট: ২০১৮-০৯-২৬ ০০:৪৬:৫৭

 

তুক’অ দামতুয়া! ঝর্নার নামটা অদ্ভুত! বিদঘুটে! ইন্টারনেট ঘেঁটে জানতে পারি মুরং শব্দ তুক অর্থ ব্যাঙ, অ অর্থ ঝিরি, দাম অর্থ মাছ আর তুয়া অর্থ উঠতে না পারা। পুরো নামের অনুবাদ করলে হয় ব্যাঙ ঝিরি যেখানে মাছ উঠতে পারে না।

‘সে আমার মন কেড়েছে’ নামের বাংলা সিনেমার মতো মাস খানেক আগে ফেসবুকের একটা গ্রুপে উক্ত ঝর্নার অদ্ভুতুড়ে নাম এবং কয়েকটা ছবি দেখে আমার মন কেড়ে নিয়েছিল। তখনি সেখানে যাওয়ার প্লান করি কিন্তু এক্সিডেন্ট করায় যাওয়াটা আর হয় নি। কোথাও যাবো ভাবলে না যাওয়া অবধি সেটা দাঁতে আটকে থাকা মাংসের মতো হয়ে থাকে। না সারা অবধি  সারাক্ষণ খচখচ করে, অস্থির অস্থির লাগে।

সেবার ব্যাটে-বলে না হওয়ায় ঈদের একদিন পরে দামতুয়া যাবো বলে প্লান করি। ঝর্ণার অবস্থান ও অন্যান্য যাবতীয় খবরাখবর নিচ্ছিলাম আর সম্ভাব্য যাদের নিয়ে যাবো তাদের রাজি করাতে মোটিভেট করে যাচ্ছিলাম। আজিজ ভাইকে অনুরোধ করি গাড়ি ঠিক করার জন্য এবং ওনি সাড়ে চার হাজার টাকায় একটা ‘নুহা’ ঠিক করেন।

ঈদের পরেরদিন খানখানাবাদ দেখতে গিয়ে শরীরে জ্বর বাধিয়ে ফেলি। যাওয়ার আগেরদিন জ্বর হওয়ায় টেনশনে পড়ে যাই। হাই পাওয়ারের ঔষধ খেয়ে জ্বর বশীকরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাই। প্রথমে সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে গাড়িতে নিয়ে আসার দায়িত্ব আমরা ছোটনকে দেই। ছোটনের অতিরিক্ত ভদ্রতায় ভরসা করতে না পেরে আমরা দায়িত্ব দেই রফিককে। রফিক হচ্ছে ধরে নিয়ে আসতে বললে মেরে নিয়ে আসার মতো। মোটামুটি সকাল সাতটায় আমাদের সবাইকে উপস্থিত করে ফেলে সে।

গাড়ি সাতসকালে নয়, নয়সকালে টইটং বাজারে আসে। আমরা নয়জন তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়ি। সাউন্ড সিস্টেমের মিউজিকের তালে তালে গাড়ি আগাচ্ছিল, সাথে আমরাও। বারোটা নাগাদ আমরা আলীকদম পোঁঁছাই। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নির্মিত আলীকদম থানচি সড়ক ধরে আমাদের গাড়ি আগাতে থাকে। গন্তব্য ১৭ কিলোমিটার নামের একটা জায়গা। কিছুদুর যাওয়ার পর রাস্তার বাঁক, নিম্মগামিতা ও উচ্চগামিতা দেখে ড্রাইভার বলে, আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? বলে, আমি আর যাবো না। অনেক বলেকয়ে আর সাহস দিয়ে তাকে নিয়ে আগাতে থাকি। তেরো কিলোমিটার নামের এক জায়গায় আমাদের নেমে যেতে হয় এবং গাড়ি ঠেলে তুলতে হয়। এরকম আরো কয়েকবার গাড়ি ঠেলতে বাধ্য হই। এভাবে আরো কিছুদূর ঠেলাঠেলি করে যাওয়ার পর থিংকু পাড়া আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছাই। সেখানে আইডি কার্ডের ফটোকপি জমা দিয়ে নাম এন্ট্রি করি এবং দায়িত্বরত সেনাসদস্যরা নির্দেশনা দেন যেন ছয়টার আগে ব্যাক করি। আরো সাত কিলোমিটার যাওয়ার পর আমরা ১৭ কিলোমিটাররের দেখা পাই। সেখান থেকে মুলত আমাদের যাত্রা শুরু। প্রথমে নেমে গপাগপ কিছু খেয়ে নিই। ভাত খেতে পারলে ভালো হতো কিন্তু ভাত পাইনি। জিজ্ঞেস করি দামতুয়া পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে। উপস্থিত সবাই বলে, আপনারা বড্ড দেরি করে ফেলেছেন। ঝর্ণার স্পটে পৌঁঁছাতে আপনাদের তিন ঘন্টা লাগবে। আসতে আরো তিন ঘন্টা। ঝর্ণা দেখে ১৭ কিলোমিটার আসতেই রাত আটটা বেজে যাবে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে, চলেন ফিরে যাই। কবির এবং হোসাইন বলে, এত কষ্ট করে যেহেতু এসেছি ট্রেকিং শেষ করেই যাবো।

দামতুয়া যাওয়ার জন্য আমরা গাইড লই। গাইডের নাম পালেঙ। ঝর্ণায় পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে জিগ্যেস করলে উত্তর দেয়, আর আধাঘন্টা লাগবে। এক ঘন্টা পর আবার যখন জিজ্ঞেস করি, পালেঙ আর কতক্ষণ লাগবে? উত্তর একই। আধাঘন্টা লাগবে। শহীদ বলে, পালেঙ এসব ঘন্টা ফন্টা বুঝে না।

আমরা সিদ্ধান্ত লই যেভাবেই হোক আমরা দামতুয়া দেখে আসবো। পাহাড়ের উঁচু নিচু রাস্তা ধরে আমরা হেঁটেই চলছিলাম। ঘন্টা দেড়েক হাঁটার পর আমাদের দমের সাথে দম আটকে যায়। এক পর্যায়ে একটা ছোট ঝর্না পাই। সবাই সেখানে জলখেলি খেলি। পায়ের ব্যথা শুরু হয়ে যায়। ফিরতে থাকা পর্যটকদের জিজ্ঞেস করি, আর কতক্ষণ লাগবে? বলে, তিন ভাগের এক ভাগ এসেছেন। আমরা হতাশ হয়ে যাই। ফিরে আসতে চাই। আমাদের টিমের কনিষ্ঠ সদস্য মিনহাজ বলে, ভাইয়া, এতটুকু এসে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় না। আমরা আবার হাঁটা শুরু করি। কখনো উঁচু কখনো নিচু রাস্তা ধরে হেঁটেই চলছিলাম। পথে মুরংদের থেকে কিনে জাম্বুরা খাই। পানি খাই। রাস্তা ফুরায় না। জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো আমরা যেন হাজার বছর ধরে হেঁটেই চলছি। পথে আরো কয়েকবার জিরাই। রাস্তা ফুরায় না। আমরা আবার সিদ্ধান্ত লই ফিরে আসবো। ফিরতে গিয়ে দেখি সুমনদা অনেকদূর সামনে চলে গেছে। আমাদের আর ফেরা হয় না। বরাবর তিন ঘন্টা হাঁটার পর ঝর্নার দেখা পাই। জীবনে বহু ঝর্না দেখেছি কিন্তু এমন দানব সাইজের ঝর্না দেখি নাই। ঝর্নার শীতল পানির আলতো নয়, বেপরোয়া পরশে শরীরের সব ক্লান্তি নিমিষেই কর্পূরের মতো হাওয়া যায়।

 

ঝর্নার পানিতে দাপাদাপি করি। মাথায় শ্যাম্পু দেই, সাবান দিয়ে গোসল করি। ছবি তুলি। গাইড বারবার ফেরার তাগাদা দেয়। কে শুনে কার কথা? সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার ফেরার রাস্তা ধরি। আবার উঠুনি। পায়ের রগে টান পড়ে। আমরা পারি না তারপরও ফিরতে হয়। এরমধ্যে সুমনদা কয়েকবার পড়ে যায়। আমরা ভয় পেয়ে যাই। নিজেরা যেখানে একা হাঁটতে পারি না সেখানে অন্যজনকে কিভাবে টানবো? তারপরও আমাদের টানতে হয়। একটু উনিশ বিশ হলেই শেষ। নিচে পড়ে গেলে লাশও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আদুপাড়া এসে আমরা আখ খাই। আবার হাঁটা শুরু করি। পিঁপড়া আমাদের কামড়ায় কিন্তু উহ আ করার সময়টুকুও আমাদের নাই। একেবারে অন্ধকার হয়ে যায়। এক হাতে লাঠি অন্যহাতে মোবাইলের টর্চলাইট। রাস্তা ফুরায় না, ভয় লাগে। ভয়টাকে উপভোগ করার সময়ও আমাদের নাই। আমরা শুধু হেঁটেই চলি। মাঝেমাঝে বড় বড় গাছের ফাঁক গলে ঠিকরে আসা জোছনার দেখা পাই। আমি বলি, কি আছে জীবনে? এখানে থেকে যাই আজকে। অন্যরকম ফিলিংস হবে। অন্যরা প্রশ্রয় দেয় না। ফিলিংস আর আমার নেওয়া হয় না। রাত আটটায় আমরা ১৭ কিলোমিটার এসে পৌঁছাই। সাড়ে আটটায় সেখান থেকে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রাত সাড়ে এগারোটায় বাড়ি পোঁছাই।

 

গাড়ি থেকে নেমে যখন রক্তাক্ত পা নিয়ে ল্যাঙ ল্যাঙ মেরে হাঁটছিলাম, একজন বলল, কি দরকার এত কষ্ট নিয়ে সেখানে যাওয়ার?  বললাম, ফিলিংস পেতে।

 

যেভাবে যাবেনঃ

 

চকরিয়া বাস টার্মিনাল হতে চান্দের গাড়ি নিয়ে আলীকদম স্টেশনে যেতে হবে প্রথমে। সেখান থেকে আলীকদম থানচি সড়ক ধরে ১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে হবে। যাওয়ার পথে থিংকু পাড়া পড়বে সেখানে আইডি কার্ডের ফটোকপি জমা দিয়ে নাম এন্ট্রি করতে হবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে। ১৭ কিলোমিটার পৌঁছে গাইড নিতে হবে এবং গাইডই আপনাকে মাইটি দামতুয়ায় পৌঁছে দিবে।

 

লেখক : ওমর ফারুক,

সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *