চট্টগ্রাম, , শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

জাহেদুল হক আনোয়ারা প্রতিনিধি

ইয়াবা পাচারের ট্রানজিট রুট আনোয়ারা,অধরা নেপথ্য নায়করা

প্রকাশ: ২০২০-০৯-২৯ ২১:০০:১৭ || আপডেট: ২০২০-০৯-২৯ ২১:০০:৩১


জাহেদুল হক, আনোয়ারা (চট্টগ্রাম)|
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পদক্ষেপের পরও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় থামছে না ইয়াবা কারবার। এর উৎসভূমি মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার হয়ে এই উপজেলায় ঢুকছে ভয়াবহ এ মাদক। এছাড়া বঙ্গোপসাগর হয়ে আনোয়ারা উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়েও আসছে ইয়াবার চালান। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তালিকাভুক্ত এবং এর বাইরে থাকা মাদক কারবারিরা আটক হয়েছে। কিন্তু অধরা থেকে যাচ্ছে অধিকাংশ ইয়াবার নেপথ্য নায়করা। নানা কৌশলে তারা মাদকের এ অবৈধ ব্যবসা জিইয়ে রেখেছে।

গত শনিবার রাতে উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ গহিরা ঘাটকূল এলাকায় অভিযান চালিয়ে মনোয়ারুল ইসলাম (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে তার ঘরের শয়নকক্ষের ভেতরে একটি প্লাষ্টিকের বস্তায় লুকানো ১ লাখ ২৫ হাজার ৪০০ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এর পরপরই ওই এলাকার আবদুল শুক্কুরের বাড়িতে পৃথক অভিযান চালিয়ে টয়লেটের ছাদ থেকে ৯০ হাজার ইয়াবা জব্দ করে কোস্টগার্ড সাঙ্গু স্টেশন। এর আগে গত ১৪ সেপ্টেম্বর একই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার ১৩০ ইয়াবা জব্দ করে র‌্যাব। জব্দ করা এসব ইয়াবা একই চালানের অংশ,যা মিয়ানমার থেকে এক সাথে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-৭ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মাহমুদুল হাসান মামুন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আনোয়ারা উপকূলের শঙ্খনদের মোহনায় অবস্থিত দক্ষিণ গহিরা ঘাটকূল এলাকাটি বনবিভাগের প্যারাবন বেষ্টিত। তাছাড়া ওই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। এ সুযোগে এলাকাটি ইয়াবা পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে গড়ে তুলেছে স্থানীয় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে রয়েছে জনপ্রতিনিধি,রাজনৈতিক নেতাসহ প্রভাবশালীরা। মিয়ানমার থেকে সাগরপথে ইয়াবা এনে এই পয়েন্ট দিয়ে নিরাপদে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। নৌপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি কম থাকায় ইয়াবার বড় মাপের চালানগুলো এ পথে পাচার হচ্ছে। এই পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা পাচারে বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করছেন পাচারকারীরা। কখনও খেতমজুর,কখনও জেলের ছদ্মবেশ ধারণ করে এই পাচার কাজ সম্পাদন করছেন তারা।


গহিরা ঘাটকূল এলাকায় গত দুই দিনের র‌্যাব ও কোস্টগার্ডের অভিযানে ইয়াবা পাচারের সত্যতা মিলেছে। আনোয়ারা থানায় এই দুই বাহিনীর করা পৃথক দুটি মামলায় ৫ জনকে আসামী করা হয়েছে। তারা হলেন, সরোয়ার আলম (৪৫),আবদুল মজিদ (৫৫),আবদুল শুক্কুর (৪৫),মনোয়ারুল ইসলাম (৪০) ও লেদু মিয়া (৩০)। তাদের প্রত্যেকের বাড়ি ওই এলাকায়। তার মধ্যে সরোয়ার আলম সিন্ডিকেট প্রধান ও তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের অভিমত, শুধু অভিযানেই বন্ধ হবে না মাদক কারবার। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অভিযানের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি,সীমান্তে নিñিদ্র প্রহরা,মাদকের চাহিদা হ্রাস,মাদকসেবীদের পুনর্বাসনসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া একক কোনো বাহিনীকে দায়িত্ব না দিয়ে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করে অভিযান পরিচালনা করলে মাদক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তারা।

আনোয়ারা থানা সূত্র জানায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আনোয়ারা থানা পুলিশ,র‌্যাব-৭ ও কোস্টগার্ড পৃথক অভিযান চালিয়ে ৫ লাখ ৪৯ হাজার ৯৬০টি ইয়াবা,৩৪২ লিটার চোলাই মদ,৬২৭ বোতল বিদেশি মদ,৭ কেজি ৮৬০ গ্রাম গাঁজা ও ১৭ বোতল ফেনসিডিলসহ ১০১ জনকে আটক করে। থানায় মামলা হয়েছে ৮১টি। উদ্ধার করা এসব মাদকদ্রব্যের বাজারমূল্য ১৭ কোটি ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৯০০ টাকা।

বর্তমানে সাগরপথে ইয়াবা পাচার হচ্ছে বেশি। সেখানে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল মাহমুদ বলেন,ইয়াবা পাচার কাজে নারী ও বেকার যুবকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের গ্রেপ্তার করা হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে আবার মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়েন তারা। এ কারণে ইয়াবা ব্যবসা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে ইয়াবা ব্যবসায় যে বা যারাই জড়িত,কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

চট্টগ্রাম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান বলেন,মাদক নির্মূল করতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। আমার বাড়ির পাশের কাউকে মাদক ব্যবসা করতে দেব না এটাই হতে হবে মূলমন্ত্র। এক্ষেত্রে এলাকার জনপ্রতিনিধি বা যে কেউ তথ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করলে মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা সহজ হবে। এর পাশাপাশি সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে হবে। যদি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর লোকবল সংকট থাকে,তাহলে অন্যান্য বাহিনীর সহযোগিতা নিতে পারে। তবে মাদক প্রতিরোধে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করলে একটা স্বচ্ছতা থাকবে এবং মাদক পাচার ৯০ শতাংশ কমে আসবে।

মাদক পাচার কেন বন্ধ হচ্ছে না জানতে চাইলে কোস্টগার্ড পূর্বজোনের স্টাফ অফিসার (অপারেশন) লে.কমান্ডার মো.সাইফুল ইসলাম জানান,কোস্টগার্ড সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাদক পাচার বন্ধসহ উপকূল সুরক্ষায় দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন,তারপরও মাদক পাচার হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ যারা ধরা পড়ছে তাদের বেশিরভাগই বাহক। তার মতে,মাদক পাচার বন্ধ করতে হলে প্রথমত মাদকের মূল নিয়ন্ত্রক যারা,তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। সিন্ডিকেটগুলো খুঁজে বের করতে হবে। মাদকের লেনদেন কীভাবে হচ্ছে,তা বন্ধ করতে হবে। যারা সেবনকারী আছে,তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। নতুন সেবনকারী যাতে বৃদ্ধি না পায়,এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে।

সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তালিকায় আনোয়ারা উপজেলায় শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। এর মধ্যে ২০ ব্যক্তিকে গডফাদার (নেপথ্যের নায়ক) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন,রায়পুরের মোজাহের (৫০), আবদুল জলিল ওরফে নুন জলিল (৪৮),আবদুল মালেক (৫০),মো.ওসমান (২৭),খোর্দ্দ গহিরার আবুল কাশেম ওরফে আবুল কাছি (৫২),মো. সেলিম (৩৮),মো.ইউসুফ ওরফে কালা মনু (৪২),আবু সালাম ওরফে আবু (২৮),মো.ওসমান (৩৫),নুরুল আলম (৫৩),পরুয়াপাড়ার হাসান মাঝি ওরফে হাসান (৫০),নুর সৈয়দ (৪০), মো.ইব্রাহিম ওরফে সুরুত ইব্রাহিম (৫২),চুন্নাপাড়ার মো.ইসমাঈল (৪০), পশ্চিমচালের আবদুর রহিম ওরফে রহিম (২৮), বাথুয়াপাড়ার সামশুল ইসলাম ওরফে সামশু (৩৮),বৈরাগের দিদারুল ইসলাম ওরফে দিদার (৩০),উত্তর চাতরীর আবদুল করিম (২৮),শিলাইগড়ার আবদুর রহিম (৫৮) ও বরুমচড়ার মো.পারভেজ (৩২)। এদের মধ্যে পাঁচজন জেলে থাকলেও অন্যরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় বহাল তবিয়তে আছেন। তাদের অনেকে সেখানে বসে আত্মীয়স্বজন এবং তাদের নিয়োজিত মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা একরকম ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। এছাড়া পুরনো গডফাদারদের পাশাপাশি সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন গডফাদার। যাদের নাম কোনো তালিকায় নেই।

স্থানীয়দের মতে,আনোয়ারা উপজেলার যেসব পয়েন্ট দিয়ে এখনও ইয়াবার চালান পাচার হয়ে আসছে সেসব পয়েন্ট হচ্ছে- নৌপথে রায়পুরের দক্ষিণ গহিরা ঘাটকূল,বরুমচড়ার ভরাচর,উত্তর জুঁইদন্ডীর ¯øুইচ গেট আর সড়কপথে তৈলারদ্বীপ সরকারহাট,চাতরী চৌমুহনী বাজার,বটতলী রুস্তমহাট ও পারকি সমুদ্রসৈকত। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে সাঙ্গু গ্যাস ফিল্ডের বাইরে বেশিরভাগ ইয়াবার চালান হাত বদল হয় বলে জানা গেছে।

অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে,ইয়াবার গডফাদাররা ‘মাস্টার প্ল্যান’ করে নিজেদের নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। মূল গডফাদাররা থাকে চার পাঁচ স্তর নিচে। সুতরাং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ইয়াবার চালান ধরা পড়লেও আসল গডফাদাররা বরাবরই রয়ে যায় পর্দার আড়ালে। বহনকারী আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। ইয়াবার মূলোৎপাটন করতে হলে উৎস বন্ধ করার পাশাপাশি গডফাদারদের নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দিতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে কোনোভাবেই পাচার হয়ে আসা ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *